ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গীদের উত্থান ও বিকাশ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১২ জুন ২০১৭

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গীদের উত্থান ও বিকাশ

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জঙ্গীবাদ’ যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তা নিয়ে বহু রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ ও দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, জঙ্গীবাদের এই বিস্তার পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আমি বাংলাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গীবাদ কিভাবে এলো এবং বিকশিত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করব। গুলশানের হলি আর্টিজানে বিদেশীদের হত্যা পরবর্তীতে চট্টগ্রামে ও সিলেটে অতঃপর মৌলভীবাজার এবং কুমিল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহে জঙ্গীদের আস্তানা, জঙ্গীদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও বিকাশ কেন, কিভাবে হয়েছে? তাদের মূল উদ্দেশ্য কি? এসব জঙ্গী হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করা এবং তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন কি সম্ভব? যেখানে পৃথিবীব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, শাসন ব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দিচ্ছে এমনকি যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই যেসব দেশে গণতন্ত্র ব্যবস্থা নেই সে সব দেশেও কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার দাবি উঠছে। আমরা সমাজতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে ধর্মকে প্রাধান্য দেই ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে। মানুষ যখন শিকারি জীবন ছেড়ে কৃষি জীবনে অনুপ্রবেশ করল, তখনই মূলত ধর্মের উদ্ভব হলো। তাই বলা যায়, আদিকালেও ধর্ম ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে ধর্মের রূপ পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে ধর্ম পালিত হয়েছে বা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। মূলত; মানুষ যখন প্রকৃতিনির্ভর ছিল, প্রকৃতির অনেক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারত না। যেমন : ঝড় কেন হয়, বৃষ্টি কেন হয়, ভূমিকম্প কেন হয়, স্বপ্নতে মানুষ বিভিন্ন স্থানে বিচরণ কেন করে, স্বপ্নে ভয় পায়, তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় সর্বপ্রাণবাদ ও মহাপ্রাণবাদে এর ব্যাখ্যা রয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর আলাদা জগত রয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করেই মিসরে পিরামিড গড়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হতো, এসব ঘটনার পেছনে কেউ না কেউ রয়েছে এবং তার অবস্থান শূণ্যে। একটি শক্তি বা ঘটনার নিয়ামক একজন। যখন এসব বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের ‘তোষামোদ’ বা ‘পূজা’ দেয়া হতো এবং এভাবেই বহু ঈশ্বরবাদের জন্ম হয়। একেশ্বরবাদের ধারণা প্রথমে আসে মিসরে, কারণ সেখানকার আবহাওয়া প্রায় একই ধরনের অর্থাৎ শীত ও গ্রীষ্ম ভারতবর্ষের মতো ষড়ঋতুর দেশ নয়। একজনই নিয়ন্ত্রক রয়েছে, এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রথম জেরুজালেমে বা মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নিল ইহুদী ধর্ম, পরবর্তীতে খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্ম যারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। হযরত মূসা (আ), হযরত ঈসা (আ) ও হযরত মুহম্মদ (স)-এর ধর্ম প্রচারের মধ্যে প্রধান ও অন্যতম প্রার্থক্য হলো, এই তিনজন মনীষীর মধ্যে হযরত মুহম্মদ (স) ক্ষমতায় গিয়েছিলেন এবং রাজ্য শাসন করেছিলেন। মদিনা শাসন করতে গিয়ে মুহম্মদ (স) মদিনা সনদ দিয়েছিলেন। সেখান তিনি ইসলাম ধর্মকে একটি মানবিক ধর্মের রূপ দিয়েছিলেন এবং সকল ধর্মের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অন্যান্য খলিফা ও মুসলমান বীররা নতুন রাজ্য জয় করেন, যেহেতু বিভিন্ন রাষ্ট্রের সামাজিক আইন, দেশীয় আইন, সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন ছিল, তাই এগুলো প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। এবং এসব ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে ইসলামের মধ্যে চারটি ধারার উৎপত্তি হয়। তবে এই ব্যাখ্যাগুলো তারা তখনই দিয়েছিলেন, যখন কোরান-হাদিসে যার কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না। এই চারটি ধারা হলো হানাফি, সাফি, হামবলী ও মালিকী। হাম্বলী মাজহাবের প্রবক্তা ছিলেন হাসান-আল বান্না, তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯২৯ সালে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন করেন। একই ধারাবাহিকতায় মওদুদী ১৯৪১ সালে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম অনুপ্রবেশ করে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের অনেক আগে। মূলত সুফীদের মাধ্যমেই বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার লাভ করে। উল্লেখ্য, সুফীবাদ ইরানে জন্ম নিয়েছিল এবং ইমাম গাজ্জালী ইসলাম ধর্মে সুফীবাদকে সমর্থন করেছিলেন। অনেকে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বা সামরিক বাহিনীর ধারণা ছিল বাংলার মুসলমানরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। যার সত্যতা সমাজ কিংবা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সুফীরা যখন বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে এসে বাংলায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যায়, তখন বাংলায় ক্ষমতায় ছিল ‘সেন বংশ’ তারাই বর্তমান হিন্দু ধর্মের ৪টি ‘কাস্টের’ বা জাতিবর্ণ প্রথা প্রবর্তন করেন এবং তখন হিন্দু ধর্ম ছিল শুধু শহরকেন্দ্রিক যা নদীয়ায় তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সাধারণত বাংলায় তখন শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, সহজিয়া ও অগ্নি উপাসক বা কোন ধর্মই পালন করত না তেমন মানুষের বসতি ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম ঈশ্বরের ব্যাপারে নীরব সহনীয়া বা বৈষ্ণব ধর্ম গাননির্ভর, সুফীবাদও গাননির্ভর ছিল। তা ছাড়া আগন্তুক পীরেরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেছেন। ইসলাম ধর্মে কোন উঁচু-নিচ না থাকা, একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া, এই বৈশিষ্ট্যগুলোর থাকার কারণে সাধারণ মানুষ খুব সহজেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে অনেক মুসলমান রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে প্রথমে রাজ্য জয়, পরবর্তীতে ধর্ম প্রচার বা গ্রহণ কিন্তু বাংলাদেশ হলো তার ব্যতিক্রম। প্রথমে ধর্ম প্রচারের ফলে এখানকার মুসলমান ধর্মকে মূল্যায়ন করেছে এটিকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে। এটিকে দেখে একটি সাংস্কৃতিক পরিম-ল হিসেবে, কখনও কট্টরপন্থী হিসেবে নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে কিছু কিছু ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে, যা আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ যদি ধর্মকে মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, এখানকার মানুষ ধর্মান্ধ নয়, তা হলে কেন জঙ্গী সৃষ্টি হচ্ছে, যারা বাংলাদেশে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কোন ধর্মের অনুসারী? যারা বোমাবাজি বা খুনের মাধ্যমে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়? নাকি এর পেছনে অন্য কোন মনস্তাত্ত্বিক কারণ নিহিত রয়েছে? সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব জঙ্গী হামলা হয়েছে, তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, একদিকে মাদ্রাসা বা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে তারা জড়িত, অন্যদিকে গুলশানের হলি আর্টিজেনের হামলার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য এবং দেশের একটি প্রথম সারির বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে তাদের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল রয়েছে, সবাই ধর্মীয় মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাহলে মাদ্রাসা ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি অনুধাবন করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো- সম্ভবত তারা তাদের কাক্সিক্ষত দর্শনের অনুপস্থিতি এবং এ জন্যই তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম নিচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা তাদের পরবর্তী কর্মস্থল নিয়ে শঙ্কিত থাকাটা স্বাভাবিক। বেশিরভাগ ছাত্র নি¤œবিত্ত পরিবার থেকে আসার ফলে তাদের ভবিষ্যত কর্মস্থল মসজিদ বা মাদ্রাসা ছাড়া অন্য কোন সম্ভাবনা না থাকার কারণেও একটি হতাশা কাজ করতে পারে, তাদের এই হতাশা থেকে জন্ম নেয় ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ’। বিষয়টি আরও গভীরভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটি সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানী দ্বারা শাসিত-শোসিত হয়েছে, গণতন্ত্র চর্চা ছিল না। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বা গণতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে হিসেবে গণতন্ত্র প্রসার লাভ করতে পারেনি। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশকে সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের আইন এবং ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইন বা অধ্যাদেশ সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রের মূল্যেবোধের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশে দীর্ঘযুগ হতে গণতন্ত্র চর্চা হয়নি, তাই সংসদ ও উচ্চ বিদ্যাপীঠে গণতন্ত্র প্রথা চালু থাকলে ধীরে ধীরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গণতন্ত্র চর্চা শুরু হতে থাকবে। এটি ধারণা করা হলেও কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সংবিধান বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আইন/ অধ্যাদেশ কোনটাই সঠিকভাবে বাংলাদেশে পালিত হতে পারেনি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে আর একটি সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা বর্তমান রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। তা আমরা আলোচনা করব। স্বাধীনতাপূর্ব কালে বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় রাজনীতির তেমন প্রভাব ছিল না। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী এবং মুসলিম লীগসহ কয়েকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ছিল। জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ।’ এসব সংগঠনের কার্যক্রম ছিল শহরকেন্দ্রিক। তাই সত্তর দশকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শহরে, গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল একমুখী। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এখনকার মতো এতটা ব্যাপক ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার শুরু হয় সত্তর দশকের পর, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সত্তর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে তেল পাওয়া যায়, তখন সেখানে সাধারণ শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে প্রচুরসংখ্যক বাংলাদেশী সেখানে গমন করে। তাদের বেশিরভাগ ছিল স্বল্প শিক্ষিত বা শিক্ষিত নয়। তাদের আয় কম এবং এই স্বল্প আয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস সম্ভব ছিল না বিধায় মরুভূমিতে একাকিত্বের জীবনযাপন করতে করতে তাদের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্টি হয় এবং ধর্মের প্রতিও কাতর হয়ে পড়ে। তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সরকার বা দেশ লাভবান হয় কিন্তু প্রেরিত অর্থ আনপ্রোডাক্টিভ যেমন : বিভিন্ন ধর্মীয় কাজ তথা মিলাদ-মাহফিল, মসজিদ, মাদ্রাসা-বসতবাড়ি পাকাকরণে ব্যয় হয় (এসব কার্যক্রমের মধ্যে একটি সামাজিক মর্যাদা বিদ্যমান রয়েছে)। বিশেষ করে, কওমী মাদ্রাসাগুলো নিজস্ব পাঠ্যসূচীতে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারী আইন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিষয়টি তাদের পাঠ্যসূচীতে পরিত্যাজ্য। এমনকি অনেক মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় পতাকাও ওঠানো হচ্ছে না। এসব মাদ্রাসাগুলো প্রসারের ক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মমন্ত্রী মাওলানা মান্নান পাঁচ বছরের জন্য তার মালিকানাধীন ইনকিলাব পত্রিকার গ্রাহক হলে গ্রামগঞ্জে, বাড়ির কাছাকাছিতে গড়ে ওঠা হেফজখানা বা ইবাদতখানাগুলো সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত হয় এবং শিক্ষকদের বিশেষ করে সেখানকার শিক্ষকরা সে অনুযায়ী বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকে। এটি আরও এক ধাপ বাড়ে এরশাদ বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ হতে অর্থ সংগ্রহের একটি শ্রেণী গড়ে ওঠে, যারা আরবী জানত তাদের লিয়াঁজো করে দিত ’৭১-এর পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধী তথা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ। এভাবেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, যতটা না প্রয়োজনে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছিল তার চেয়ে বেশি বিশেষ কোন শ্রেণীর বাড়তি সুবিধাভোগের জন্য এগুলো গড়ে উঠেছিল। এসব মাদ্রাসায় যেহেতু বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে পড়ানো হয়, সেহেতু গরিব ছাত্রছাত্রীরা এদিকে ঝুঁকে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোন গ্রাম পাওয়া যাবে না, যেখানে একের অধিক মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে ওঠেনি। এসব মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর দ্বারা বিশারদ শ্রেণী গড়ে উঠবে যারা চিন্তা-চেতনায় আধুনিক চেতনার পশ্চাদমুখী হবে। পূর্বে যে সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিম-লের অবস্থা ছিল তাতে বর্তমান আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাসীন দলের সরকার সৌদি সরকারী খরচে একটি করে মসজিদ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর ফলে গ্রামগঞ্জে ধর্মীয় রাজনৈতিক চেতনার সুর উঠেছে তার সঙ্গে বাঙালী জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। প্রকারান্তে গণতন্ত্রের মূল্যবোধের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ধর্মীয় চেতনায় অনুপ্রাণিত এসব দল আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে অথবা বাংলাদেশ যে জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তার দর্শনকে গিলে খেতে পারে। লেখক : অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×