ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ

রহস্যেঘেরা ক্যাডেট মাদ্রাসা, তালিম দেন মিসর ফেরত শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৮ মে ২০১৭

রহস্যেঘেরা ক্যাডেট মাদ্রাসা, তালিম দেন মিসর ফেরত শিক্ষক

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া, ২৭ মে ॥ রহস্যময় এক মাদ্রাসা। সামনেই সাইনবোর্ড খাইরুল উম্মাহ ক্যাডেট মাদ্রাসা। প্লে থেকে দশম শ্রেণী। আবাসিক/ অনাবাসিক/ ডে-কেয়ার। যোগাযোগের ঠিকানা। এই পর্যন্ত লেখা একটি সাইনবোর্ড রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করলেই তিনটি লম্বা টিনশেড দোতলা ঘর, যেখানে নিচে ক্লাস চলে আর দোতলায় আবাসিক অবস্থান। দুটিতে ছাত্র এবং অপরটিতে ছাত্রীদের ক্লাসসহ আবাসিক অবস্থান। এটিতে আবার গ্রামের সহজ-সরল মহিলাদের জড়ো করে সাপ্তাহিক তালিম চলে। তালিম দেন মিসর থেকে সম্প্রতি ফিরে আসা শিক্ষক জিয়াউল হাসান। তার মূল বাড়ি বরগুনায়। প্রতিষ্ঠানটির বয়স প্রায় দেড় বছর। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গেল বছর যখন এ জমিতে লাগানো ধানের শীষ বের হয় তখন ওই ফসল কেটে তড়িঘড়ি করে পানির মধ্যে তিনটি টিনশেড ঘর করা হয়, করা হয় একটি মসজিদ। মহিপুর মৎস্যবন্দর থেকে পশ্চিম দিকে আধাকিলোমিটার দূরেই এ আলোচিত মাদ্রাসার অবস্থান। নজিবপুর গ্রামে। ওই মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইস্রাফিল জানায়, সকাল আটটায় তাদের ক্লাস শুরু হয়। চলে দুপুর একটা পর্যন্ত। নামাজের বিরতিসহ তিনটা পর্যন্ত ছুটি থাকে। তিনটায় শুরু হয় প্রাইভেট ক্লাস। চলে আছর পর্যন্ত। এরপর ছুটি। মাগরিব থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত চলে লেখাপড়া। ক্লাস চলাকালে এ মাদ্রাসা ক্যম্পাসে কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি শিক্ষার্থীর অভিভাবক পর্যন্ত। স্থানীয় বসিন্দা আবু শিকদার জানান, চারদলীয় জোট সরকারের সময় এ জমি কেনা হয়। তখন এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইসমাইল হোসেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। এখন মাদ্রাসাসংলগ্ন এলাকায় থাকেন। তিনি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে তার দাবি। কেউ আবার প্রকাশ্যে বলছেন, এদের সঙ্গে বরগুনার মাওলানা জসিম উদ্দিনের প্রতিষ্ঠিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আবু শিকদার আরও জানান, গেল বছর হঠাৎ মাইক্রোযোগে ছয়জন লোক আসে। তারা গোপনে ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করে ওই রাতেই আবার চলে যায়। ক্যাডেট মাদ্রাসা হলেও আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাস পড়ানো হয় বলে শিক্ষার্থীদের দাবি। রাতের বেলা আবাসিকভাবে মাদ্রাসায় প্রায় ৫০ জন ছাত্র অবস্থান করে। এদের কাছ থেকে মাসিক খাওয়া খরচ বাবদ শ্রেণীভেদে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা নেয়া হয়। মাসিক কোচিং বাবদ ক্লাস থ্রি-ফোরে ৫০০, পঞ্চম-ষষ্ঠ ৭০০ এবং সপ্তম-দশম ৮০০-৯০০ টাকা বাড়তি নেয়া হয়। ক্যাম্পাসের পেছন দিয়ে টিনের বাউন্ডারিঘেরা ছাত্রীদের নির্দিষ্ট ক্লাসঘর রয়েছে। প্রায় ৭৫ ফুট লম্বা। দোতলা এ ঘরটির নিচতলায় ক্লাস চলে। প্রায় ৭০ ছাত্রী ছিল। রাতে দোতলায় অবস্থান করত ২৫-৩০ জন। এখন ছাত্রীদের আবাসিক শাখা বন্ধ রয়েছে। তাও প্রায় ১৫ দিন। এছাড়া প্রতি শুক্রবার অন্তত ৮০-৯০ জন মহিলার অংশগ্রহণে তালিমের ব্যবস্থা রয়েছে। তিনটা থেকে আছর পর্যন্ত চলে তালিম। তালিমের শিক্ষক থাকেন ইসমাইল হোসেনের জামাতা জিয়াউল হাসান। তিনিও দীর্ঘ সময় নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। প্রত্যক্ষভাবে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে গ্রামের অসংখ্য মানুষের দাবি। জিয়াউল হাসান ওই মাদ্রসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বরত। তিনি এক সময় মিসরেও থাকতেন বলে নিশ্চিত করেছেন এলাকাবাসী। সেখান থেকে সর্বশেষ মাত্র তিন মাস আগে এসেছেন। তারা মিসরে লোক পাঠাতেন। স্থানীয় হারেজ মিয়ার ছেলেদের মিসরে পাঠানোর লেনদেন নিয়ে সালিশ বৈঠক পর্যন্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলে এ প্রতিনিধির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার খবরে শুক্রবারের তালিম আর হয়নি। গ্রামের অসচেতন সরল-সহজ মহিলারা মাদ্রাসায় গেলেও তালিমের শিক্ষক জিয়াউল হাসান আসেননি। মাদ্রাসাসংলগ্ন পাঞ্জেগানা মসজিদের ক্যাশিয়ার মোঃ শাহআলম জানান, তাকে এখানকার কোন হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে জানানো হয় না। গোপন বৈঠকের সময় তাদের দূরে রাখা হয়। স্থানীয় কাউকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না। ইসমাইল হোসেনের ভাইয়ের ছেলে মোঃ রাকিবুল। তার জামাতার ভাগ্নে বরগুনার মোঃ আমিনুল ইসলামকে শিক্ষক এবং মহিলা শাখার প্রধান হিসেবে নিজের মেয়ে মোসাম্মৎ সুমাইয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাগেরহাটের হাফেজ মজিবর রহামন তার বন্ধু হওয়ায় চাকরি করছেন। মসজিদটির ইমাম হিসেবে স্থানীয় হাফেজ আবু সালেহ নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু গ্রামবাসী প্রতিবাদী হওয়ায় আবু সালেহকে ইমামের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। আবু শিকদার আরও জানান, মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে অচেনা লোকজন এসে ক্লাস নেন। অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাদের শিক্ষার্থীরা চেনে না। অষ্টম শ্রেণীর রাকিবুল, নবম শ্রেণীর আব্দুল মালেক এমন ধারণা দেয়। ইতোপূর্বে এ মাদ্রাসায় স্বঘোষিত প্রিন্সিপাল ইসমাইল হোসেনের নিজস্ব কিছু বই-পুস্তক শিক্ষার্থীদের পাঠ করানো হতো, যা এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গ্রামবাসীর খোলামেলা মন্তব্য, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ক্ষমতার সময় ইসমাইল হোসেন হঠাৎ ৭৬ শতক জমি কেনেন। গেল বছর অচেনা ছয়জন লোক আসার পরের দিন কাঁচা ধান কেটে মাদ্রাসার কাজ শুরু করা হয়। এখানে পাঁচতলা ভবন তোলার কথা বলা হয়েছে। ৫০ শতক জমি এখন মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে রয়েছে। বাকি ২৬ শতক নিজ দখলে। এসব অর্থের উৎস কী তাও কেউ জানে না। এখানে আবাসিক শিক্ষার্থীর জন্য একটি প্রিন্টেড খাবার মেনু রয়েছে, যা ফলো করা হয় না। সকলের ধারণা, অজানা কোন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে ইসমাইলের যোগাযোগ রয়েছে। মাদ্রাসার অনেক তথ্যই গ্রামবাসীর কাছে লুকানো হয়েছে। এখনও লুকানো হচ্ছে। মেয়েদের থাকার ঘরটি একটি গোডাউনের মতো। জানালায় ছালা টাঙানো। নাওভাঙ্গা ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান জানান, স্বামীর এজাজত ছাড়া এবং পর্দা ছাড়া পরপুরুষের কাছ থেকে তালিম শেখার কোন সুযোগ নেই। সবচেয়ে ভাল তালিম স্বামী শিখে এসে স্ত্রীকে শেখাবে। শুধুমাত্র নজিবপুর গ্রামের জেলে-কৃষক শ্রেণীর সাধারণ সহজ-সরল মানুষকে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে মহিলাদের জড়ো করে এসব কাজ করছে মাওলানা ইসমাইল-এমন মন্তব্য অধিকাংশ মানুষের। এ বিষয়ে মাওলানা ইসমাইল জানান, এটি একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। খাইরুল উম্মাহ ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা লোন নিয়ে তিনি মাদ্রাসাটি করেছেন। সরকারী অনুমোদনের জন্য কার্যক্রম চলছে। তার সঙ্গে জামায়াতের কোন সম্পৃক্ততা নেই এবং তিনি ঢাকায় লেখাপড়া করেছেন বলে জানান। তার দাবি, মসজিদের ইমামকে নিয়ে সমস্যার পর থেকে তার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের জন্য একটি মহল এমন অপপ্রচারে নেমেছে। আওয়ামী লীগ নেতা মহিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম আকন জানান, ওদের কার্যক্রম সন্দেহজনক। তিনি বলেন, এইট-নাইনের মেয়েদের রাতে মাদ্রাসায় ওই পরিবেশে রাখা আমার ভাল মনে হয় না। প্রশাসনের এটি দেখা প্রয়োজন। মহিপুর থানার ওসি মোঃ মিজানুর রহমান জানান, এ বিষয়ে তাকে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তবে মসজিদ গঠন নিয়ে স্থানীয়দের বিরোধ রয়েছে। তারপরও খোঁজখবর নিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদিউর রহমান বন্টিন জানান, ওই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার আগে সরকারের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন ছিল। স্থানীয় প্রশাসনসহ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বিষয়টি নজরে নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া কঠোর নজরদারির প্রয়োজন বলেও এ মুক্তিযোদ্ধা জানান। কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম সাদিকুর রহমান জানান, বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখছেন।
×