ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

ফিলিস্তিনী শান্তি তবে সুদূর পরাহত

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৭

ফিলিস্তিনী শান্তি তবে সুদূর পরাহত

একবার উন্মাদনা পেয়ে বসলে তার থেকে ফেরত আসা সহজ নয়। বরং তা চরমতম পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনবাসীর স্বাধীনতাকে ভ-ুল করে ইসরাইল রাষ্ট্রের মাহাত্ম্য বৃদ্ধিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তার অনুমোদনের জন্য যে নির্বাহী আদেশ তৈরি করা হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তিকর নয় যেমন, তেমনি বিশ্ব শান্তির পথেও অন্তরায়। আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগঠন বা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে স্বীকৃতি দেবে বা সমর্থন করবে, সেসব সংস্থাও সংগঠনে মার্কিন অর্থায়ন বন্ধ হবে। এমন আদেশ প্রদান ট্রাম্পকেই মানায়। ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর সেনা অভিযান ও নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকাই মেনে চলেছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের নীতি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে, সেই নীতির বাস্তবায়নে দৃষ্টিগ্রাহ্য তেমন কোন ভূমিকা নেয়নি। তবে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার আগে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা ফিলিস্তিনীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় বসে ট্রাম্প তা উল্টে দিতে চাইছেন। যা দীর্ঘদিন ছিল কল্পনারও অতীত, সেটাই বাস্তবে পরিণত করেছিলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটদানে বিরত থাকার সুবাদে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে ১৪-০ ভোটে পাস হয়েছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রস্তাব। ইসরাইলের দখল করা ফিলিস্তিনী অঞ্চলে নতুন বসতি স্থাপনের ইসরাইলী পদক্ষেপকে জাতিসংঘ অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। যা বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। ফিলিস্তিনীদের বিতাড়িত করে সব ফিলিস্তিনী ভূখ-কে ইসরাইলী দখলে আনার মূল লক্ষ্যের পরিপন্থী কোন প্রস্তাব জাতিসংঘে পাস হতে দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের দীর্ঘকালের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অর্থ ও অস্ত্র সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্র উপস্থিত থাকতেও তীব্র ইসরাইল বিরুদ্ধতার মতো অসম্ভব কাজ সম্ভব হওয়ার ঘটনা মনে হতে পারে অলৌকিক। ভোটদানে বিরত থাকা চিরকালীন মার্কিন নীতির সুচিন্তিত সংশোধন। বস্তুত দশকের পর দশক ধরে একের পর এক অমানবিকতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধ অপরাধ সত্ত্বেও আমেরিকার ইসরাইল প্রীতি ও প্রেম সামান্যটুকুও শিথিল হয়নি। মূলত পদে পদে ইসরাইলকে অন্ধভাবেই সমর্থন করে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এবারই প্রথম গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর বিস্ময়করভাবে ছন্দ পতন ঘটে গেছে ওবামা প্রশাসনের বিদায় বেলায়। স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি যেমন ইসরাইলের কাছে অত্যন্ত ক্ষোভের, তেমনি গোটা বিশ্বের কাছে নতুন জল্পনার উপাদান হিসেবে প্রতিভাত হয়, ট্রাম্প অবশ্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোটদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানালে তা কাজে দেয়নি। ক্ষিপ্ত ইসরাইল বলেছিল, প্রেসিডেন্ট ওবামার আমেরিকা কেবল ভোটদানে বিরত থেকেছি, তা নয়, প্রস্তাবটি রচনাও করেছে তারা এবং সবাইকে এককাট্টা করে তা পাস করিয়ে নিয়েছে। ওবামা প্রশাসন এই অভিযোগে আপত্তি জানালেও বসতি নির্মাণ নিয়ে তাদের মত যে জেনে ও বুঝেই দেয়া হয়েছে, মুক্তকণ্ঠে সে কথা স্বীকার করেছে। ‘বন্ধু কখনও বন্ধুর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে যায় না’Ñ ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এই ব্যথিত বক্তব্য বজ্রকঠিন হুমকির সঙ্গে মিশে ভেসে এসেছে, ‘এর ফল ভাল হবে না।’ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এর ফল ভাল মন্দ যেমনই হোক, নিঃসন্দেহে গুরুতর হবে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ওবামা কিছুকাল ধরেই ইসরাইলের প্রতি অনাবিল মার্কিন সমর্থনের ধারার গতি কমিয়ে দিচ্ছিলেন। ঘটনা হচ্ছে, বসতি নির্মাণ নিয়ে দু’দেশের দ্বিমত বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব পাস অতীতের সবকিছু ছাপিয়ে গেছে। ইসরাইলের আশা ছিল, জাতিসংঘ পর্যন্ত অশান্তি কখনও গড়াবে না। ওয়াশিংটনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেই কোন না কোনভাবে নিষ্পত্তি হবে। সেই আশায় ছাই পড়ার ফলে ইসরাইল প্রশাসনের সঙ্গে মার্কিন ইহুদী লবিও ক্ষুব্ধ। ওবামার বিরুদ্ধে তাদের স্বর ছিল প্রবল। মার্কিন রাজনীতি এবং অবশ্যই অর্থনীতি যেহেতু অনেকাংশেই ইহুদী নেতৃত্ব নির্ভর, এই বিক্ষোভের জের ট্রাম্পকেও প্রভাবিত করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের ঘটনা তখনই বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওবামাও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে অতি দ্রুত একটি বিভাজন তৈরি করেছে। ট্রাম্প যেহেতু সর্বার্থেই নব্যপন্থী, প্রথা ভেঙ্গে নিজের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই তিনি ঘোষণা করেন নিজের ভবিষ্যত নীতি। বলেছিলেনও, ক্ষমতায় এসেই তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে দেবে। দিচ্ছেনও তাই। ট্রাম্প দায়িত্ব নিতে না নিতেই ফিলিস্তিন দখলের তোড়জোড় শুরু করে দেয় ইসরাইল। দখলকৃত পশ্চিম তীরে নতুন করে আড়াই হাজার বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ইসরাইল। যা বড় পরিসরের বসতি হতে যাচ্ছে। তাদের এই শক্তির যোগানদাতা ট্রাম্প। এর আগে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমেও ৫৬৬ বসতির নির্মাণ কাজ শুরু করছে। ইসরাইলী কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেয়ার পর খেলার নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। ওবামার আমলের মত এখন আর তাদের হাত বাঁধা নেই। তাই অবশেষে তারা বসতি স্থাপন করতে পারছে। ক্ষমতায় বসেই ট্রাম্প উগ্রপন্থী ইসলামী জঙ্গীদের উৎখাতের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতেও ফিলিস্তিনীরা শঙ্কিত। ট্রাম্পের চোখে জঙ্গী শুধু আইএস, আল কায়েদা নয়। ফিলিস্তিনীরাও সন্ত্রাসী উগ্রবাদী এবং জঙ্গী হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে প্রতিভাত হয়ে উঠছে। সিরিয়ায় শান্তি অঞ্চল গঠনের ঘোষণা দেয়া ট্রাম্প ফিলিস্তিন ও ইসরাইলে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। বরং তার তৎপরতা, আদেশ ও ঘোষণা সবই ফিলিস্তিন জাতি ও তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়া দেশের সংখ্যা বিশ্বের মোট ১৯৬ দেশের মধ্যে ১৩৭। সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দেয় ভ্যাটিকান। পোপ নিজে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূতকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালের ১৬ নবেম্বর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। সে বছরই নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় ফিলিস্তিন। একই সময়ে ভারত, ভুটান, চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সৌদি আরবও স্বীকৃতি দেয়। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে জাতিসংঘ সদর দফতরে ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ানো হয়। যার বিরোধিতা করেছিল ইসরাইল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কাটারও ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়ার জন্য ওবামার প্রতি আহ্বান জানিয়ে গত ডিসেম্বরে বলেছেনও, আশা করি ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে যথাযথ ভূমিকা রাখবে যুক্তরাষ্ট্র, আর তা প্রেসিডেন্ট বদলের আগেই। তবে এ জন্য হাতে সময় খুব কম। কারণ নয়া নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যুগ শেষ হয়ে গেছে।’ কাটারের মতে, ফিলিস্তিনের নিজের মাটিতে প্রবেশ করে একের পর এক স্থাপনা বানিয়েই যাচ্ছে ইসরাইল। ফলে বার বার বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন ফিলিস্তিনীরা। ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের বিরোধ প্রাক জন্মলগ্ন সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। বস্তুত পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবেই ফিলিস্তিন ভূখ-ের একাংশে গড়ে ওঠে ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র। আগে ইসরাইল নামে কোন দেশের অস্তিত্ব ছিল না। আরব বিশ্ব এবং পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ইসরাইলের মাধ্যমেই নিজস্ব ভূমিতে জমি তৈরির ব্যবস্থা করে। মুসলিম প্রধান বিশ্বের মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূ-খ-ে মার্কিন এজেন্ট হিসেবেই উত্থান ঘটে ইসরাইলের। লক্ষণীয়, ফিলিস্তিনীয় পিতৃ ভূমিতে গড়ে তোলা নতুন দেশ ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তিন আজও পূর্ণ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। ইসরাইলের বাধাহীন প্রসার ও শক্তি সামর্থ্য বাড়ানোর জন্যই ফিলিস্তিনকে রেখে দেয়া হয়েছে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ হিসেবে। সেই সুযোগে ইসরাইল নির্বিচারে ফিলিস্তিনীর ওপর উৎপীড়ন চালিয়েছে। তাদের ধনে-প্রাণে নিঃশেষ করার জন্য লাগাতার সামরিক ও পুলিশী বর্বরতা চালিয়েছে। যা এখনও চলছে। ইসরাইলী বিমান বাহিনী ও স্থলবাহিনী বোমা-বুলেটে গুঁড়িয়ে দিয়েছে একের পর এক ফিলিস্তিনী জনবসতি। তারপর সেই জায়গা দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছে ইসরাইলী জনপদ। এইভাবে ক্রমাগত প্রসারিত হয়েছে ইসরাইলের আয়তন। আর ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে ফিলিস্তিন। এইভাবে জমি দখল ও ইসরাইলের বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিস্তিন। কর্ণপাত করেনি। বরং প্রতিবাদের মাত্রা তীব্র হলে বেড়েছে দখলদারিত্ব। জাতিসংঘে একাধিকবার এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব এলেও কোনদিন তা পাস করা যায়নি মার্কিন ভেটো দানের ফলে। মার্কিন নিরাপত্তার গ্যারান্টিতে ইসরাইল তাদের সীমানা বাড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে অনুরূপ প্রস্তাব এলেও ওবামা প্রশাসনই তা পাস করতে দেয়নি। এবারও তা ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। প্রথমে প্রস্তাবটি আনার কথা ছিল মিসরের। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের চাপে মিসর সরে যায়। তারপর সেনেগাল, ভেনিজুয়েলা, মালয়েশিয়া ও নিউজিল্যান্ড মিলে প্রস্তাবটা পেশ করে। ট্রাম্প চেয়েছিল আমেরিকা ভেটো দিয়ে প্রস্তাব বাতিল করুক। কিন্তু জিমি কার্টারের আহ্বান মাথায় ধারণ করে ওবামা প্রশাসন ভেটোদানে বিরত থেকে প্রস্তাবটি পাস করায়। ক্ষমতায় বসার আগেই ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের যে ঘোষণা দেন, তা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। ক্ষমতায় বসে কট্টরপন্থী এক আইনজীবী ডেভিড ট্রাইম্যানকে ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী মনোনীত করেন। তারও ভাষ্য দূতাবাস সরানোটা ট্রাম্প প্রশাসনে বিশেষ প্রধান্য পেয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ বলেছে, স্থানান্তর করা হলে ইসরাইলকে ইতিপূর্বে রাষ্ট্র হিসেবে যে স্বীকৃতি দিয়ে ফিলিস্তিন তা রদ করবে। দূতাবাস স্থানান্তর বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য এক চপেটাঘাত, যার মানে হচ্ছে দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রক্রিয়ার সমাপ্তি। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্যই তাদের দূতাবাস তেল আবীবেই রেখেছেন। তবে ট্রাম্পের ঘোষণার পর শান্তি প্রক্রিয়াই ভেঙ্গে যেতে চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। পারস্পারিক স্বীকৃতির অংশ হিসেবেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ফিলিস্তিন। ১৯৯৩ সালে আলো চুক্তি অনুযায়ী নেয়া এই পদক্ষেপ বৈধতা হারাবে স্থানান্তর হলে দূতাবাস। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় শান্তি আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনায় জেরুজালেমের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে অবশ্যই। এই শহরটি ইসলাম, ইহুদী ও নাসারা (খ্রীস্টান) ধর্মেরই তীর্থস্থান। ফিলিস্তিনীরা চায় পশ্চিম তীরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে এর রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করতে। ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে রেখেছে। পূর্ব জেরুজালেমকে নিজেদের অবিভাজ্য রাজধানী বলে দাবি করে আসছে ইসরাইল। অবশ্য বিশ্ব সম্প্রদায় পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের শতাব্দীরও বেশি বসতি স্থাপন করেছে হাম্মাম। আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এ বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে বিবেচনা করা হলেও ইসরাইল তা মানতে নারাজ। শুধু ফিলিস্তিনীরাই নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশেই মনে করে জেরুজালেম মুসলমানদের জন্য অতি পবিত্র স্থান। যা ফিলিস্তিনীদের অধিকারেই থাকবে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং মুসলমানদের প্রতি অপঘাত দিতেই ট্রাম্প দূতাবাস সরাচ্ছেন। অবশ্য বিশ্বের কোন দেশেরই দূতাবাস নেই জেরুজালেমে। ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন গোটা বিশ্বেরই রয়েছে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের পক্ষে উত্থাপিত যাবতীয় প্রস্তাবে সব সদস্য দেশের সমর্থন ছিল, কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ছাড়া। কিন্তু সর্বশেষ প্রস্তাব পাসের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ট্রাম্প ইসরাইলের পাশে থাকার কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণের পর ইসরাইলের মানসিক ও সামরিক অবস্থান বদলেছে। ট্রাম্প সেই ক্ষোভে জাতিসংঘের চেহারাও বদলে দেয়ার কথা বলেছেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসছেন। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জর্দানের রাজধানী আম্মান থেকে টোকিও যাওয়ার পথে ঢাকায় যাত্রাবিরতিকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের পাশে বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকেই সমর্থন করে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান খাতে দু’দেশ সমঝোতায়ও পৌঁছেছে। এবার সফলকালে মাহমুদ আব্বাসকে বাংলাদেশ আবারও জানিয়ে দেবে, তাদের মুক্তি সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। ইসরাইলীর আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের পক্ষেও কথা বলে আসছে। মাহমুদ আব্বাস আবশ্য ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলের রাজধানী হস্তান্তরকে স্বাধীন ফিলিস্তিনী ভূখ-ে আগ্রাসনের শামিল হবে জেরুজালেম সবার উপাসনার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত। জেরুজালেমের বর্তমান মর্যাদা ক্ষুণœ হয়, এমন কোন পদক্ষেপ নিয়ে ফিলিস্তিন তা মেনে নেবে না। দু’দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি প্রত্যাহারের দাবি বিশ্ববাসীর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনের জন্য চা এবং মেডিক্যাল টিম পাঠান। বঙ্গবন্ধু ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আরবদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘ এবং ওআইসিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে উন্মাদনা দেখিয়ে আসছেন, তা বিশ্ব শান্তির অন্তরায়। মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি বহাল রাখায় মার্কিন প্রশাসন অতীতে যা করেছে তার কয়েক ধাপ এগিয়ে ট্রাম্প যে পথ বেছে নিয়েছেন, তা ফিলিস্তিনীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাত্রা আরও বাড়াবে। প্রেসিডেন্ট আব্বাস সফরে আসার পর বাংলাদেশ তাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবে। আর স্বাধীন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে বহাল রাখার পথে এগিয়ে যাবেই।
×