ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

জামায়াতের সহায়তায় গণতন্ত্র উদ্ধার করবে বিএনপি!

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

জামায়াতের সহায়তায় গণতন্ত্র উদ্ধার করবে বিএনপি!

গত ১১ ডিসেম্বর টেলিভিশনের খবরে দেখলাম বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আদর্শের মিল নেই, গণতন্ত্র উদ্ধার করার জন্য জামায়াতকে জোটে রাখা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে চূড়ান্ত বিজয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের মাস হচ্ছে ডিসেম্বর। তাই গর্ব করে আমরা বলি ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। এ মাসের গৌরব আবহমানকাল ধরে আগামী দিনের বাঙালীর জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে। এই বিজয়ের মাসে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের একাধারে প্রাক্কালে জামায়াতকে গণতন্ত্র উদ্ধারের কা-ারি হিসেবে তকমা প্রদান এবং মহিমান্বিত করার অর্থ কি দাঁড়ায়, আর বিএনপির মহাসচিব সেই দায়িত্ব পালন করছেন কেন? বাংলাদেশে গণতন্ত্র কতটুকু আছে, পূর্বের থেকে বেশি না কম এবং জামায়াত-বিএনপির আমল থেকে বর্তমানে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ভাল না মন্দ সেটা একটা ভিন্ন ইস্যু। আজকের লেখার বিষয় সেটা নয়। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অস্তিত্ব যখন সঙ্কটের মুখে তখন বিএনপি গণতন্ত্রের সনদ দিয়ে জামায়াতকে বাঁচিয়ে রাখার যে অপচেষ্টা করছে তার তাৎপর্য এবং পূর্বাপর আজকের লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করব। একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা বিজয় অর্জন করি। ১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়া দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা প্রদান না করে গণহত্যার পথ বেছে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বিজয়ের মাসে যে জামায়াতকে বিএনপি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে সনদ দিচ্ছে, সেই জামায়াত একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গে এক হয়ে গণতন্ত্র হত্যায় অংশ নেয় এবং গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ফোর্স হিসেবে কাজ করে। গত ৪৫ বছরে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত একবারের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেনি, তাদের কোন অনুশোচনা নেই এবং কখনও তারা বলেনি যে একাত্তরে তাদের অবস্থান ভুল ছিল। অর্থাৎ একাত্তরের অবস্থান থেকে জামায়াত এক চুলও সরে আসেনি। এহেন জামায়াতকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে ‘ক্লিন চিট’ প্রদানের অর্থ হলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অপমান করা, অস্বীকার করা এবং বিজয় দিবসের গর্ব ও অনুপ্রেরণার জায়গাকে বিতর্কিত করা। কারণ, একাত্তরের অবস্থানে বহাল থেকে জামায়াত যদি গণতান্ত্রিক শক্তি হয়, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা হয় দুষ্কৃতকারী, যে কথা তারা একাত্তরে বলত। বাংলাদেশের জামায়াত ওয়াহাবিতন্ত্র এবং মওদুদীবাদী রাজনীতির ধারক বাহক, এ কথা কি বিএনপি অস্বীকার করতে পারবে? ওয়াহাবিতন্ত্র ও মওদুদীবাদের লিখিত দলিলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গণতন্ত্র মুসলমানদের জন্য হারাম এবং কুফরি মতবাদ। জামায়াত যে রাজনৈতিক দল নয়, একটা সন্ত্রাসী সংগঠন, এ কথা সারা বিশ্বের মানুষ জানে। কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিক রেগুলেশন গ্রহণের মাধ্যমে আহ্বান জানানো হয় বিএনপি যেন জামায়াতকে পরিত্যাগ করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালে ছাত্র শিবিরকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব জেনেও আজ ২০১৬ সালের বিজয়ের মাসে জামায়াতকে ক্লিন চিট প্রদানের মাধ্যমে বিএনপি দেশের মানুষকে কি বার্তা দিতে চায়? এই প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন মানুষ এটাও জানে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত-বিএনপি মুদ্রার এপিট-ওপিট মাত্র এবং তারা দুজনে রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ, যে কথা বিএনপির সুপ্রীম লিডার তারেক রহমান বলেছেন। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তা না হলে একাত্তরের ঘাতক দলের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের একটা সীমা রেখা অন্তত থাকত। দুইয়ের মধ্যে কোন সীমান্ত মানুষ কখনও দেখতে পায়নি। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সংসদে বিএনপির একাই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কী বাধ্যবাধকতায় জামায়াতের দুজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বানালেন? তাই আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ নির্বাচনে জয়ী না হওয়ার পরেও বিএনপি যখন তাকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী বানায় তখন মানুষের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। একটু পেছনে গেলে তাদের সম্মিলিত উদ্দেশ্যটি আরও স্পষ্ট হয়। পূর্ব-পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন বহাল রেখে জামায়াতের প্রয়াত আমির গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসার সুযোগ পেলেন এবং তার অনুমতি দিলেন তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। সেই সময়ে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে পারমিশন পেয়ে জামায়াত পুনরায় বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতের রাজনীতির ধারাবাহিক একটা বিশ্লেষণমূলক মূল্যায়ন করলে যে কেউ দেখতে পাবেন, তারা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে সেই পূর্ব-পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের কাজটিই করে চলেছেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির সম্মিলিত শাসনের সময় তার অনেক আলামত দেখা গেছে। তখন বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে শুধু পাকিস্তানের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ওই সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, আশ্রয়-প্রশ্রয়সহ সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ট্র্যাজেডি হলো এহেন দেশবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী এখনও দেশে রাজনীতি করছে এবং জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থনও পাচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে ফুলের তোড়া অর্পণ করে মানুষকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হচ্ছে। এর অবশ্য একটা কারণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। স্বাধীনতা অর্জনের মূল অনুষ্ঠানকে ছয় দফা অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ এরা রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি এবং অন্যান্যভাবে, আবার কেউ নীরবে পাকিস্তানের সহযোগী ও সমর্থক ছিল। ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনামসহ যে কোন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, এ রকম একটা সংখ্যা সব দেশের মূলস্রোতের বাইরে গিয়ে নিজ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে থাকে এবং দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক পক্ষ একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে এক সময়ে ওই স্বাধীনতাবিরোধীরাও বাস্তবতা ও সত্য মেনে নিতে বাধ্য হন এবং মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে দেশের মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে যান। যার ফলে কোন দেশেই স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে আর কিছু থাকে না। বঙ্গবন্ধু আরও দশটি বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে পারলে বাংলাদেশেও তাই হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনরুত্থান ঘটায় তারা বরঞ্চ একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এরা ওই সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় এখনও তাদের ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করছে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো পরাজয়ের গ্লানি ভোলা কঠিন এবং সুযোগ পেলে পূর্বের চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর হয়। যার বহির্প্রকাশ বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতের মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তির পর আমরা দেখেছি। তবে ইতিহাসের শিক্ষা অথবা নিয়তির অমোঘতা, যাই বলি না কেন, যে উদ্দেশ্যে ও আদর্শের কারণে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে তা চিরদিনের জন্য মিথ্যা এবং বৃথা হয়ে যেতে পারে না। তাই গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষ আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠেছে। পরিপূর্ণ অর্থে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায় মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ। অফুরন্ত চেতনার এই জাগরণকে ঠেলে ফেলে একাত্তরের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের আর সুযোগ নেই। সব দেশে এক সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের উপলব্ধি ঘটে এবং সত্যকে মেনে নেয়। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে বিএনপির মহাসচিব জামায়াতকে যেভাবে ক্লিন চিট প্রদান করলেন তাতে মনে হয় তারা নিজেরা সংশোধিত হবেন না। ইতিহাসের পথ ধরেই সব কিছুর মীমাংসা হবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী দল। এ দেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। বিএনপি এতদিন তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে সময় এসেছে মিথ্যা ও নকল কোরামিন দিয়ে বিএনপি আর জামায়াতকে রক্ষা করতে পারবে না। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নিউ অরলিনস, ইউএসএ
×