ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ শাহ্রিন আক্তার চাঁদনী

১০ বছর পর আবার রাজীব...

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

১০ বছর পর আবার রাজীব...

বিশ্বখ্যাত বাঙালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র হিন্দী সিনেমার নাম ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি।’ শতরঞ্জের অর্থ হচ্ছে দাবা খেলা। যুদ্ধংদেহী বোর্ড ক্রীড়া হিসেবে দাবা খেলার সুনাম রয়েছে। খেলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রতিপক্ষের ঘুঁটি আয়ত্তে আনার মাধ্যমে নতস্বীকারে বাধ্য করা। এ খেলার জন্ম ভারতবর্ষে বলে সর্বাধিক প্রচলিত মতবাদ। এছাড়া পারস্য (বর্তমান ইরান) দেশে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত শতরঞ্জ এবং চীনে দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত শিয়াংছী নামক খেলাকে দাবার পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করার পক্ষেও মতামত আছে। কথিত আছে- রাবণের স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধে নিবৃত্ত করার জন্য রাবণের সঙ্গে দাবা খেলতেন। প্রাচীন ভারতীয় খেলা হিসেবে দাবার সংস্কৃত শব্দ শতরঞ্জ খেলাটি পরিবর্তিতরূপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ক্রীড়াবিদরা দাবার কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে খেলাটির ধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা। এ খেলায় জিততে হলে বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সরিয়ে বা চাল দিয়ে বিপক্ষের রাজাকে ফাঁদে ফেলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, দাবার পরিভাষায় যাকে বলে ‘কিস্তিমাত।’ ইতিহাস বলে, বুদ্ধির এ খেলাটির উৎপত্তিস্থল ভারতে। তবে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার কিন্তু ভারতের নয়! ১৯৮৫ সালে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব লাভ করেন বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ। তাঁর পরে আরও চারজন এ খেতাবের অধিকারী হন। তাঁরা হলেন- জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, এনামুল হোসেন রাজীব এবং আবদুল্লাহ আল রাকিব। রিফাত ছাড়া বাকি চারজনই এবার অংশ নিয়েছিলেন সদ্যসমাপ্ত জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে। আর তাতে বাকি তিনজনকে পিছনে ফেলে শিরোপাটা একান্তই নিজের করে নেন রাজীব। ১০ বছর পর জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হলেন ১৯৮১ সালে জন্ম নেয়া। এটা তার তৃতীয় শিরোপা। ত্রয়োদশ ও শেষ রাউন্ডে তিনি হারান আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদকে। রাজীব সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সেই ২০০৬ সালে। প্রথমবার শিরোপা জিতেছিলেন ১৯৯৭ সালে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অডিটোরিয়ামে জাতীয় দাবার ৪২তম আসরের ত্রয়োদশ রাউন্ডে নিয়াজকে হারিয়ে ১১ পয়েন্ট নিয়ে অপরাজিত থাকেন রাজীব। ১৩ রাউন্ডে রাজীবের জয় নয়টি, ড্র চারটি। ফিদেমাস্টার রেজাউল হকের সঙ্গে শেষ রাউন্ডে ড্র করে সাড়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে রানারআপ হন অপর গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব। এ বছরেই ভারতের বিশাখাপত্তম থেকে ভাইজ্যাগ ওপেন গ্র্যান্ডমাস্টার্স টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছিলেন রাজীব। জাতীয় দাবায় শিরোপা জেতার পরদিনই (২৩ নবেম্বর) দলবদল করেন রাজীব। যোগ দেন সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে। আসন্ন প্রিমিয়ার ডিভিশন দাবা লীগে অংশ নেবে দলটি। নবাগত এই ক্লাবে রাজীব ছাড়াও আরও যোগ দিয়েছেন অপর দুই গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ এবং আবদুল্লাহ আল রাকিবও। শুধু তাই নয়, বিদেশ থেকেও সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার আনার চেষ্টা করছে দলটি। রাজীবের আগের ক্লাব ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব পেয়েছেন দেশের প্রথম জাতীয় মহিলা ইন্সট্রাক্টর মাহমুদা হক চৌধুরী মলি। ্িস্ময়কর ব্যাপার- ২০০৮ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর এই প্রথম জাতীয় দাবার শিরোপা জিতলেন তিনি! স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, চ্যাম্পিয়ন হতে এত সময় লাগল কেন? উত্তর একটাই- দাবা ফেডারেশনের আগের কমিটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অনেকটা বিরক্ত হয়ে তিন বছর দাবাই খেলেননি তিনি! যদিও জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে কখনোই খুব একটা উদগ্রীব বা চাপে ছিলেন না রাজীব। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টারের খেতাব পান রাজীব। প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টারের প্রথম নর্ম অর্জন করেন ২০০২ সালে, সেøাভেনিয়ায় অনুষ্ঠিত দাবা অলিম্পিয়াডে। এরপর দ্বিতীয় নর্ম অর্জন করেন রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০৭-এর দাবা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে, বিশ্বের উনবিংশ দাবাড়– ইউক্রেনের পাভেল এলজানভের বিপক্ষে জয়ী হয়ে। ২০০৮ সালের ৪ মে রাজীব তার তৃতীয় ও চূড়ান্ত জিএম নর্ম লাভ করেন। এর ফলে তিনি বাংলাদেশের পঞ্চম (এবং আপাতত সর্বশেষ) গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবধারী হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। রাজীব এনামুল নামে ইন্টারনেট চেস ক্লাবেও দাবা খেলে থাকেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর আবারও জাতীয় দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ো রাজীব আগামীতেও দেশে-বিদেশে তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×