ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আব্দুল মালেক

হোয়াইট হাউসের মধুচন্দ্রিমা কি মধুহীন হবে!

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

হোয়াইট হাউসের মধুচন্দ্রিমা কি মধুহীন হবে!

নির্বাচনের দিন যখন প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে কড়া নাড়ছে মার্কিন ভোটারদের দরজায় তখন যেন তীরভাঙা ঝড়ে দু’কূল হারানোর পথে যাচ্ছে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি অর্থাৎ রিপাবলিকান দল। যার এক কূলে দলীয় প্রাইমারি ভোটে মনোনয়নপ্রাপ্ত বিজনেস মোগলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্বপ্নের সৌধ আর অন্য কূলে মার্কিন দুই কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অক্ষুণœœ রাখা। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের সম্ভাবনার পারদ বারবার নিম্নগামী হয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ী মোগলকে নিয়ে নানা কারণে দলের তাবড় তাবড় নেতাদের রিজারভেশন থাকায় জিওপি এস্টাব্লিসমেন্ট হোয়াইট হাউসের পথ দিয়ে হাঁটেনি তেমন। উপরন্তু অনেক তারকা নেতৃত্ব ঘোষণাই দিয়েছেন দলীয় প্রার্থীকে তারা ভোট দেবেন না। এবার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল সেই দলে ভিড়ে ঘোষণা দিলেন তিনি ভোট দেবেন হিলারিকেই। কাজে কাজেই শ্বেত বাড়িটি দখলের চেষ্টায় বৃথা শক্তি ক্ষয় করবার প্রচেষ্টা জিওপির একেবারে নেই। দল বরং সমুদয় শক্তি প্রয়োগ করে বাঁচাতে চাইছেন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে তাদের বর্তমান নিয়ন্ত্রণ। স্মরণ করিয়ে দেয়া ভাল আমেরিকার প্রতি অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন ৮ বছর মেয়াদে দু’জন করে মোট এক শ’ সিনেট সদস্য। কিন্তু একটি মাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সকল সদস্য একই সঙ্গে নির্বাচিত হন না। এই নির্বাচন হয়ে থাকে দুই টার্মে। ‘হোয়াইট হাউসসহ কংগ্রেসের উভয় কক্ষ যদি আবার ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তবে সেটা হবে দুঃস্বপ্নের মতো এক দৃশ্যকল্প’- স্পিকার পল রায়ানের সাম্প্রতিক এমন বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় উঠেছে। এই কথার সঙ্গে তিনি আরও যোগ করলেন যদি ডেমোক্র্যাট দল আসন্ন নির্বাচনে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে বিজয়ী হয় তবে আবার নতুন করে চালু করা হবে তাদের উদারপন্থী নীতির ঘড়িটি। এমন দুর্ঘটনাটি নিশ্চিতভাবে ওবামা ক্ষমতাকালের চাইতে হবে অধিকতর মন্দ। কারণ হোয়াইট হাউস ও আইন সভার উভয়কক্ষই তখন থাকবে ডেমোক্র্যাটদের হাতের মুঠোয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ওবামার আমলে আইন সভার উভয়কক্ষ ডেমোক্র্যাটদের কব্জায় ছিল প্রথম দু’বছর মাত্র। ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি নির্বাচনের চারটিতেই কংগ্রেসের উভয়কক্ষে ঘটেছে ভাগাভাগির বিজয়। ডেমোক্র্যাটরা ২০০৮ সালে দু’বছরের জন্য উভয়কক্ষের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছিল। কিন্তু ’১২ সালের নির্বাচনে দুটি কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ হারায় রিপাবলিকান পার্টির কাছে এবং অদ্যাবধি কংগ্রেসের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে। ডেমোক্র্যাট দল হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সঙ্গে আইন সভাতেও ফিরে চায় পুনর্দখল। হারিয়ে ফেলা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে তারা একই সঙ্গে লড়ছে হোয়াইট হাউস ও ক্যাপিটাল হিলের পথে। আইন সভার দুই কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে জাতিকে দেয়া আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতিগুলো আইন সভার মেজরিটি বিরোধী সদস্যের ভেটোর কারণে কখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। যেমন, ইমিগ্রেশন সমস্যার সমাধানে প্রেসিডেন্ট ওবামার নীতিটি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস অনুমোদন না করায় সেটি আইনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। তারপর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের ঘটনায় সৌদি আরবকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে- এমন একটি বিলে প্রেসিডেন্ট ভেটো দেয়া সত্ত্বেও আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই আইন পাস করে। শেষ দিকে এসে সুপ্রীমকোর্টের জাস্টিস এন্টোনিও স্ক্যালিয়ার মৃত্যুর পর প্রয়োজনীয় ৬০ ভোট না পাওয়ায় রাষ্ট্রপতি ওবামা কর্তৃক মনোনীত বিচারপতি নিয়োগ সিনেট কর্তৃক ব্লক করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির রয়েছে ৫৪, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৪৪ ও বাকি দু’জন ইন্ডিপেন্ডেন্ট, যার মধ্যে একজন বার্নি স্যান্ডার্স। আগামী ৮ নবেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গে ৩৪টি সিনেট আসনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সিনেটের নিয়ন্ত্রণ পেতে ডেমোক্র্যাট দলকে ৫টি আসনে জয়লাভ প্রয়োজন। অবশ্য ৪টি আসন পেলেও তারা বিজয়ী হবে। কারণ তাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট যদি নির্বাচিত হন তখন তিনি সিনেটের সভাপতি হবেন বিধায় তাকেও একজন ডেমোক্র্যাট সদস্য হিসেবে গণ্য করা হবে। এবারের ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ৩০টি আসন দরকার। পূর্বাভাস বলছে তারা অন্তত ১৫টিতে জয়ী হবেন। গত দশকে দেখা গেছে ডেমোক্র্যাট দল যে বছর প্রেসিডেন্ট পদ পেয়েছে সে বছর জিতে নিয়েছে কংগ্রেসের উভয়কক্ষই। তবে তারা মিড্ টার্ম ইলেক্শনে তা ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে আইন সভায় রিপাবলিকান পার্টির যে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে তা ১৯২৮ সালের পর রেকর্ড। আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসের দুটি কক্ষেই তাদের যথেষ্ট সংখ্যক প্রার্থীর আসন হারানোর সম্ভাবনার কথা মিডিয়ায় বলা হচ্ছিল। কিন্তু এই লেখাটি যখন শেষ হতে যাচ্ছিল, ২৬ অক্টোবর রাতের খবরে জানা গেল দু’দলের মধ্যে সিনেট লড়াই হাড্ডাহাড্ডি পর্যায়ে পৌঁছেছে। হিলারি প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়ে যদি আইন সভায় ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা না যায় তবে বলা হচ্ছে হোয়াইট হাউসে তার মধুচন্দ্রিমা মধুহীন হয়েই থাকবে। সেই হলিউড এক্সেস বাসে বুশ বংশের বিলি বুশের সঙ্গে প্রার্থী ডোনাল্ড লুচ্চা কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হবার পর জনমনে যে বিরূপতার শুরু সেটারই বিস্তার ঘটছে ক্রমশ। বিলি কর্মস্থল এনবিসি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন আর ট্রাম্প কথিত ‘ক্রুকেট মিডিয়া’র কাছে একের পর এক রমণীকুল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনতে লাগলেন যৌন হেনস্থার অভিযোগ। আগের লেখায় বলেছি ঘটনাগুলো সে সময়ের ক্যাটাগরি ৪ হ্যারিকেন ম্যাথুর মতো জোরদার হয়ে আঘাত করেছিল রিয়েল স্টেট্ সম্রাটের প্রাসাদ অলিন্দে। কিন্তু তারপরেও উঠে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী ধনপতি কিছুটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। তবে বড় সর্বনাশটি হলো ভোটে কারচুপি করা হবে এমন এক ঘোষণা দেয়ায়। সর্বশেষ বিতর্কের পর থেকে তিনি বলতে লাগলেন ‘নির্বাচনী ফলাফল অবশ্যই মেনে নেব যদি আমি বিজয়ী হই।’ রক্ষণশীল ভোটার মহল এ যাবত তার যাবতীয় কার্যকলাপ, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, এমনকি ঔদ্ধত্যকে শুধু বরণ করা নয় সেটিকে সমর্থনও করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন জাতি হিসেবে এবার আঁতে ঘা লাগায় মিত্রদের অনেকেই মুখ ফেরালেন তার দিক থেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন নিমজ্জনের মুখেও ফ্লোরিডার সেন্ট অগাস্টিনের জনসভায় একরকম হাতুড়ি পিটিয়ে আওয়াজ তুললেন ‘বন্ধুরা আমরা জিতছি, আমরা জিতছি, জিতছি’। ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটারে ঘোষণা ছিল ‘আমরা জয়ী হতে যাচ্ছি প্রেস রিপোর্টগুলোতে সেটা অস্বীকার করা হচ্ছে।’ কিন্তু তার প্রচারণা ব্যবস্থাপক কেলিয়ান কনওয়ে এনবিসির মিট দ্য প্রেসের কাছে বললেন, ‘আমরা পিছনে’। অবশ্য এর কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘এই নির্বাচনে হিলারি রয়েছেন চরম সুবিধাভোগীর ভূমিকায়। তার স্বামী একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, যার নেতৃত্বে চলছে প্রচারাভিযান, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি, ভাইস প্রেসিডেন্ট সবাই তার হয়ে কাজ করছেন।’ শেষ ডিবেটকালে প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ বলার প্রেক্ষিতে সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে প্রচারাভিযানকালে ন্যাস্টি শব্দটাকেই যেন আগুনে বোমার মতো নিক্ষেপ করলেন ট্রাম্পের দিকে। অনলবর্ষী ভাষণে এলিজাবেথ বললেন, এটা ‘ন্যাস্টি নারীদের ভোট। শুনুন ডোনাল্ড- ন্যাস্টি নারী কত টাফ হতে পারে, ন্যাস্টি নারী কত স্মার্ট হতে পারে সেটা ৮ নবেম্বর ন্যাস্টি নারীদের ভোটে দেখবেন। যখন আমাদের জীবন থেকে আপনাকে চিরতরে মুক্তি দিতে ন্যাস্টি পদক্ষেপে লংমার্চ করতে করতে আমরা ন্যাস্টি ভোট দিতে যাব!’ কদর্যতা, অশ্লীলতার চরম শিখরে অবস্থান নিয়েই আসন্ন মার্কিন নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই এসব কদর্যতা যেন পেয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত রূপ। একজন ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের মূর্তির আকারে নিরাবরণ একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রত্যুষকালে নিউইয়র্ক বোলিং গ্রিন পাতাল রেল স্টেশনের বাইরে স্থাপন করে তোলপাড় সৃষ্টি করা হয়। অবশ্য ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই একজন মহিলার ক্রোধের মুখে পুলিশ এসে স্ট্যাচুটি সেখানে রাখার পূর্ব অনুমতি নেয়া হয়নি একথা বলে সেটি সরিয়ে নেয়। ইতোপূর্বে গত আগস্টে অপর প্রার্থী ডোনাল্ডের এক নগ্ন প্রতিমূর্তি ইউনিয়ন স্কয়ারে স্থাপন করে সাড়া ফেলে দেয়া হয়েছিল। ডোনাল্ডের তাজমহল নামে ক্যাসিনোটি ইতোপূর্বেই লাটে উঠেছে নাকি দেনার দায়ে। এবার তার রাষ্ট্রপতি হবার সাধের তাজমহলটিও ভাঙ্গনের মুখে। প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে পোলগুলোতে অতি বর্তমানে যে বিস্তর ফারাকের সৃষ্টি হয়েছে সেটি পূরণ করা আর সম্ভব বলে মনে হয় না। সেই সঙ্গে বলতেই হবে এক ভূমিধস বিজয়ের লক্ষ্যে হিলারি এগিয়ে যাচ্ছেন নিশ্চিতভাবে। তিনি রিপাবলিকান সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত ফ্লোরিডা, ওয়াহাইও, আইওয়া, নর্থ ক্যারোলিনায় ঝটিকা প্রচার অভিযানে নেমেছেন। হিলারি ক্লিনটন তাদের কাছে বলছেন তিনি শুধু ডেমোক্র্যাট দলের নন, হতে চান রিপাবলিকান ইন্ডিপেন্ডেট দেশের সকল মানুষের প্রেসিডেন্ট। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]
×