ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রিয় নবী (সা)-এর মহান মর্যাদা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

প্রিয় নবী (সা)-এর মহান মর্যাদা

বিশ্বজগত আল্লাহ্ জাল্লার কুদ্রতের এক অপূর্ব নিদর্শন। নূরে মুহম্মদী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা করেন। তিনি প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করে তাঁকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর খ্যাতি ও আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। তিনি একমাত্র তাঁকেই নিজের হাবীব অর্থাৎ প্রেমাস্পদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিজের নাম মুবারকের পার্শ্বে তাঁর হাবীবের নাম যুক্ত করেছেন এভাবে : লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর হাবীবকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেছেন : আমি কি আপনার বক্ষ আপনার কল্যাণে প্রশস্ত করে দেইনি? আমি আপনার বোঝা দূর করে দিয়েছি এবং আপনার খ্যাতিকে সুমহান মর্যাদায় উন্নীত করেছি (সূরা ইন্শিরাহ্ : আয়াত ১-৪)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহ্র প্রেমাস্পদ এবং আল্লাহ্ তাঁর প্রেমিক- এমন মহান মর্যাদা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু কেবল তাঁকেই দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন, ফেরেশতারাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন এবং মু’মিনদের আল্লাহ্ তা’আলা দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে মুমিনগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও (সূরা আহ্যাব : আয়াত ৫৬)। এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টির পটভূমি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের খাতিরেই বিরাট বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং একে করেছেন সুশোভিত ও সুসজ্জিত। আল্লাহ্ হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন অর্থাৎ বিশ্বজগতের রব্ আর তাঁর হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তিনি করেছেন রহমাতুল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের রব্ আর তাঁর হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুমহান মর্যাদা নিহিত রয়েছে। রউফুর রহীম আল্লাহ্র দু’খানি মুবারক গুণবাচক নাম। আল্লাহ্ তাঁর এই দুটি গুণবাচক নামে তাঁর হাবীবেরও পরিচিত করেছেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট এক রসূল এসেছেন। তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি রউফুর রহীম- দরার্দ্র পরম দয়ালু (সূরা তওবা : আয়াত ১২৮)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের বহু পূর্বে উর্ধ জগতে নবুওয়তের অভিষেকে অভিষিক্ত হন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁরই মাধ্যমে নবুওয়তের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার সূচনা করেন এবং তাঁর দ্বারা পৃথিবীতে নবী আগমন ধারার সমাপ্তি ঘটান। তিনিই সর্বপ্রথম এবং তিনিই সর্বশেষ। তিনি সাইয়েদুল মুরসালিন আবার তিনিই খাতামুন্নাবিয়িন। তিনি বলেছেন, আমি রসূলগণের ভূমিকা, আমি নবীদের উপসংহার- এতে আমার কোন ফখর (অহঙ্কার) নেই। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমেই আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র দীন আল ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমরা জানি প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে যারপর নেই জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হয়েছে। তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। তিনি এক পর্যায়ে আল্লাহ্র নির্দেশে মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করেছেন। এখানে গড়ে তুলেছেন এক আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। কিন্তু শত্রুরা বসে থাকেনি। মক্কার কাফির-মুশ্রিকরা মদীনায় ইয়াহুদী ও মুনাফিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে মদীনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। যুদ্ধের পর যুদ্ধ হয়েছে। সব যুদ্ধই ছিল শত্রু বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করার। সব যুদ্ধে শত্রু বাহিনী পরাজিত হয়েছে। অতঃপর মক্কা বিজয় হয়েছে। ঘোষিত হয়েছে : সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবার। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ ইন্তিকালের মাত্র ৯০ দিন পূর্বে তিনি হজ করতে আসেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে। বিদায় হজ নামে পরিচিত এই হজকে হুজ্জাতুল ইসলাম, হুজ্জাতুল বালাগ নামেও অভিহিত করা হয়। তিনি সেদিন আরাফাত ময়দানের সেই বিশাল জনতাকে উদ্দেশ করে যে ভাষণ দেন তা বিদায় হজের ভাষণ বা খুতবা নামে পরিচিত। এই খুতবায় তিনি বললেন : আজ আমার পায়ের তলায় অন্ধকার যুগের সকল অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, শিরক, কুফর দলিত-মথিত হলো। তিনি বললেন : আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো এই জনপদটির মতো, তোমাদের একের ধনসম্পদ, মান-ইজ্জত, জান-প্রাণ-রক্ত অপরের নিকট পবিত্র। তিনি সেদিন এই দীর্ঘ ভাষণ শেষে সবাইকে আল বিদা জানান। আর তখন নাযিল হয় : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম, আমার সব নিয়ামত তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবের আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। আল্লাহ্ ছিলেন এক গুপ্ত খাজিনা। তিনি প্রকাশ হবার ইরাদা করে প্রথমে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূর সৃষ্টি করেন। এই নূরই নূরে মুহম্মদী। এই নূর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাবত্ মখ্লুক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হযরত আদম (আ) যখন পানি ও মাটির মধ্যখানে ছিলেন তখন আমি খাতামুন্নাবিয়িন বা নবীগণের সমাপ্তি হিসেবে বিদ্যমান ছিলাম। একজন সাহাবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আপনাকে কখন নবী করা হয়েছে? উত্তরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমার নিকট হতে যখন নবুওয়তের মীসাক (অঙ্গীকার) নেয়া হয় তখন আদম রুহ ও দেহের মধ্যখানে ছিলেন। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম আল্লাহ্র নির্দেশে যখন কা’বা ঘরের দেয়াল তুলছিলেন, তখন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর দরবারে এই বলে দু’আ করেছিলেন : হে আমাদের রব্! আমাদের দু’জনকে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার এক অনুগত উম্মত সৃষ্টি কর। আমাদের ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের রব্! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রসূল প্রেরণ কর যে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৮-১২৯)। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম বনী ইসরাঈলের নিকট প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব হবার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম বলেছিল : হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহ্র রসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তওরাত আছে তার আমি সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রসূল আসবেন আমি তাঁর সুসংবাদদাতা (সূরা সাফ্ফ : আয়াত ৬)। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু এতই ভালবাসেন যে, তিনি তাঁর নাম ধরে ডাকেননি। কুরআন মজীদে ইয়া আদাম! ইয়া মুসা ইত্যাদিভাবে নবীগণকে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে এভাবে- ইয়া আইয়োহান্নাবী, ইয়া ইইয়োহাল মুদ্দাছ্ ছির, ইয়া আইয়োহাল মুয্যাম্মিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মহিমা ও গুণ-মাধুর্য জগতজুড়ে সৌরভ বিলিয়ে আসছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় তাঁর জীবনচরিত রচিত হয়েছে। বিভিন্নকালের জ্ঞানী-গুণী মনীষীগণ তাঁর প্রশংসায় মুখরিত হয়েছেন। জেএইচ ডেনিসন এ্যাজ দ্য বেসিস অব সিভিলাইজেশন গ্রন্থে লেখেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে, সভ্য জগত উপনীত হয়েছে নৈরাজ্যের তুঙ্গে, তখন এটাই প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, চার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিশাল সভ্যতা বিখ-িত হবার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং মানবজাতি বর্বরতার চরম অবস্থায় যেন ফিরে গিয়েছে, যেখানে প্রতিটা জাতি ও গোত্র পরস্পরের বিরোধী ছিল, আইনশৃঙ্খলা বলতে কোথাও কিছু ছিল না। খ্রিস্টধর্মের দ্বারা নিত্যনতুন নিয়ম-অনুশাসন ঐক্য ও শৃঙ্খলার বদলে বিভেদ এবং ধ্বংসের কাজ করছিল। এই জনগোষ্ঠীর (আরবদের) মধ্যে সেই পুরুষপ্রবর জন্মগ্রহণ করলেন, যিনি পূর্ব ও দক্ষিণের সমগ্র জানা দুনিয়াকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য আবির্ভূত হলেন। হিরো এ্যান্ড হিরো ওয়ারশিপ-এ স্যার টমাস কারলাইল লিখেছেন : সে এক মহাপরিবর্তন, কী এক দারুণ পরিবর্তন ও প্রগতি সূচিত হলো মানবকুলের বিশ্বজনীন অবস্থায় ও চিন্তায়! আজকের যুগে আল্লাহ্র বৃহত্তর সংখ্যক মখ্লুক অন্য যে কোন বাণীর চেয়ে হযরত মুহম্মদ (সা)-এর বাণী বেশি বিশ্বাস করে।... আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের মধ্যেই ইসলামের অর্থ নিহিত রয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীতে নাযিলকৃত আসমানী জ্ঞানের মধ্যে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। আরব জাতির জন্য এটা ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ! আরব এরই পরশে প্রথমবারের মতো জিন্দা হয়ে উঠল। টমাস কারলাইল অন্যত্র বলেন, এক জাতি, তাঁর নাম আরব, একজন মানুষ নাম তাঁর মুহম্মদ (সা) আর সেই একটা শতাব্দী। এটা কি তাই নয়, যেন একটি স্ফুলিঙ্গ, শুধু একটি স্ফুলিঙ্গ পড়ল এমন এক পৃথিবীর ওপর, যা দেখে মনে হতো তমশাচ্ছন্ন অজ্ঞাত বালুকণা, কিন্তু দেখ! সেই বালুকণা বিস্ফোরিত হলো বারুদের মতো আকাশ সমান আলো করে আর সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে অমর কবি মওলানা আবদুর রহমান জামী আরবী-র্ফাসী মিশানো ছন্দবদ্ধ চার পঙ্ক্তিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। সেই সুন্দর পঙ্ক্তিমালার বাংলা অনুবাদ এমন : হে সৌন্দর্যের অধিপতি, যে মানবকুলের সরদার। তোমার চেহারার জ্যোতিতে আলোকিত হয়েছে চন্দ্র/আমার কাছে নেই কোন যোগ্য ভাষা তোমার প্রশংসা করার/সংক্ষিপ্ত সারকথা হলো আল্লাহর পরেই তোমার মর্যাদা। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×