ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইইউতে থাকা না থাকার দোলাচলে ব্রিটেন

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৮ জুন ২০১৬

ইইউতে থাকা না থাকার দোলাচলে ব্রিটেন

রোম ঘোষণার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছিল তা আজ নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে যা করা হয়েছিল, তা এখন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক স্বার্থের প্রশ্নে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। প্রভাবশালী সদস্য রাষ্ট্র জার্মানি, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশের মধ্যে যতই বৃহত্তর ঐক্য, সমঝোতা ও সংহতির কথা বলা হোক না কেন, ব্রিটেন কিন্তু এখনও ইউরোপের অর্থনৈতিক মুদ্রা ব্যবস্থার বাইরে অবস্থান করছে। ইউরোপীয় সদস্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরো ব্রিটেনের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। ব্রিটেন তাদের মুদ্রা পাউন্ড স্টারলিং, জাতীয় পতাকা এবং ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্টে প্রণীত আইনের মধ্যে কোন হস্তক্ষেপ চায় না। ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ মনে করে, এগুলো তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ব্রিটেন রাজনৈতিকভাবে এক ইউরোপে রূপান্তরের কথা ভাবতে পারে না। শুধু উন্নত অর্থনীতিই নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাসহ বহু ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা প্রকাশ্যেই তাদের অগ্রবর্তী ভাবে। ইইউ’র আইন-কানুন সবক্ষেত্রে ব্রিটেনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কিংবা সমগামী নয়। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে ব্রিটেন তা জাতীয় ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য হারাতে চায় না। সে ক্ষেত্রে কেউ কেউ ব্রিটিশ মনোভাবকে আধিপত্যবাদী মনে করলেও বিভিন্ন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধাকে বড় করে দেখে। তাঁরা চায় না ব্রিটিশ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা কোনভাবে বিঘিœত হোক। ইউরোপের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র থেকে অগণিত মানুষ কর্মসংস্থানের সন্ধানে এসে ব্রিটিশ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা এবং বহু যুগ ধরে অর্জিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিক। ব্রিটিশরা ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করতে চায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করতে চায়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধান অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকরা অবাধে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে পারে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের মতে, কর্মহীন ব্রিটিশ নাগরিকরা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেয়ে থাকে। তাছাড়া আবাসিক সুযোগ-সুবিধা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনুদান ও ঋণ গ্রহণ করতে পারে, যা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে না। এ বক্তব্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের। তাঁর মতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য নাগরিকরা ব্রিটেনে এসেই স্থানীয় নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধার অংশীদার হতে পারে না। তার জন্য ব্রিটিশ নাগরিকদের কর্মরত অবস্থায় ইন্স্যুরেন্সের অর্থ প্রদান করতে হয়। এগুলো তাদের আইনী ব্যবস্থা। সুতরাং এতে আঘাত পড়লে ব্রিটিশ সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রটি ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ইউরোপীয় সদস্য দেশের কোন নাগরিক ব্রিটেনে এসে বসবাস কিংবা কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করলেও প্রথম চার বছর তার জন্য ব্রিটিশ সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো প্রযোজ্য হবে না। একটানা ব্রিটেনে চার বছর কর্মরত থাকার পর বহিরাগতদের জন্যও প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা কার্যকর হতে পারে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউনিয়নের সভাপতি ইয়েঙ্কারের সঙ্গে সম্প্রতি বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করেছেন। কিন্তু আগামী ২৩ জুন ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা বা না থাকা নিয়ে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি মৌলিক বিষয়। বহু আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত হলেও ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী স্যার এ্যাডওয়ার্ড হীথের আমলে ব্রিটেন ইইউতে যোগ দেয়। কিন্তু জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো পূর্ণাঙ্গভাবে নয়। নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড এখনও ইইউতে যোগ দেয়নি, কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য ঠিকই করছে। তুরস্ক ইইউ-তে যোগদানের ব্যাপারে প্রথম দিকে তৎপরতা দেখালেও এখন মনে করে ইউনিয়নের বাইরে থেকে ব্যবসাবাণিজ্য করাই তাদের জন্য অধিক লাভজনক। তুরস্কের সদস্য পদের জন্য আগে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে তদবির করলেও এখন অনেকটা নিরুত্তাপ। অন্যদিকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের কান্ট্রি সাইডের নাগরিকরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাবাপন্ন। তারা চায় না ইউরোপীয় হলেও ভিন্নভাষী ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ক্রমাগতভাবে ব্রিটেনে এসে তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করুক। এ ক্ষেত্রে তারা উপমহাদেশের মানুষ অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশীদের বেশি পছন্দ করে। কারণ উপমহাদেশের মানুষ ইংরেজী জানে। তাছাড়া তাদের খাদ্য ব্রিটেনে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পোশাক ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। তদুপরি ক্রিকেটের বেলায় সবাই একাট্টা। এমন বহু ধরনের বাদানুবাদ, তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে ২৩ জুন। ঐ দিনই ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। মতামতের বিষয় একটিই- ইইউতে থাকবে কি থাকবে না। তারপরও সবকিছুর উর্ধে থেকে যায় ইউরোপকে বাদ দিয়ে ব্রিটেন যেমন একাকী ক্ষতির সম্মুখীন হবে ঠিক ব্রিটেনকে বাদ দিয়ে ইউরোপও দুর্বল হয়ে যাবে। এদিকে স্কটল্যান্ড গত বছর ব্রিটেন ত্যাগ করে গণভোটের মাধ্যমে স্বাধীন হতে চেয়েছিল, তারাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করায় পক্ষে নয়। তাদের অধিকাংশ মানুষই ইইউ-তে থাকার পক্ষে। সবাই ইইউ থেকে লাভবান হতে চায়। তাছাড়া ইইউ’র সব সদস্য রাষ্ট্রের সরকারগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নীতি এক নয়। তদুপরি একমাত্র জার্মানি ছাড়া সব সদস্য রাষ্ট্রেরই কমবেশি রয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। নিজেদের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে প্রায় সবাই হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা এবং না থাকার ব্যাপারে। ব্রিটেনের নাগরিকদের বিভিন্ন মতামত ও অভিব্যক্তিতে এখন প্রতিনিয়ত তারই বহির্প্রকাশ ঘটছে। অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা বাদ দিলে ব্রিটেন এখনও ইউরোপের মধ্যমণি। শিক্ষা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে ব্রিটেন সবাইকে টানে। এ অবস্থায় আলোচনা ও বিতর্কের ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা নীরব পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। ইউরোপে থাকার ব্যাপারে লন্ডন, বিশেষ করে তরুণ সমাজ বেশি উদাসীনতায় ভুগছে। এই তো গত সপ্তাহেও ছিল উদাসী, এ সপ্তাহে তারাই আবার ষাট থেকে চল্লিশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ক্রমে ক্রমে প্রতিদিনই যেন পরিবর্তন ঘটছে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর মধ্যেও। রক্ষণশীল দলীয় ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবর্ণ বলেছেন, ব্রিটিশ ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হত্যাগ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা গেছে, ইউনিয়ন ত্যাগের কারণে প্রথম দুই বছরে লন্ডনে ৭৩ হাজার চাকরি চলে যাবে এবং ঘর-বাড়ির মূল্য ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় ৬২ হাজার পাউন্ড স্টারলিং পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইইউ ত্যাগ করার ফলে প্রতিটি কর্মজীবী ব্রিটিশ পরিবার দুই বছর পর বছরে গড়ে আট শ’ পাউন্ড-স্টারলিং ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ মুহূর্তে যখন ব্রিটেনে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তখন গ্রীস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালসহ কয়েকটি ইইউ সদস্য রাষ্ট্র অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। এ সঙ্কট নিরসনে জার্মানি ও কয়েকটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। ইইউ এর সব সদস্যের লোকসংখ্যা, সম্পদের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক অবস্থা এক নয়। আবার সব সদস্য রাষ্ট্রের ইউরোপীয় মুদ্রা ব্যবস্থার অধীনেও পরিচালিত হয় না। এ ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক। সবাই ইইউ থেকে লাভবান হতে চায়, ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। তাছাড়া ইইউ’র সব সদস্য রাষ্ট্রের সরকারগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নীতি এক নয়। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করলে ব্রিটেনের লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে প্রতিবছর তিন লাখের অধিক মানুষ এখন ব্রিটেনে আসছে। কিন্তু এদের সবাই ইউরোপীয় নয়। ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ছিল প্রতিবছর তারা এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করবে। কারণ যাদের ব্রিটেনে এসে কাজ করার অনুমতি দেয়া হবে, তাদের পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাও সরকারকে দিতে হবে। বর্ধিত বহিরাগত মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি না করা হলে প্রকৃত ব্রিটিশ নাগরিক ও তাদের সন্তানরা দুর্ভোগের শিকার হবে। প্রকৃত ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা তখন স্কুলে স্থান পাবে না, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখানো কিংবা হাসপাতালে জায়গা পারে না। এ বিষয়গুলোই বয়স্ক ব্রিটিশ নাগরিকদের অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত অভিবাসন কিংবা বহিরাগতদের চাপে ব্রিটেনের জনসংখ্যা এখন বেড়ে যাচ্ছে। এমন অপরিকল্পিত জনসংখ্যা শীঘ্রই ব্রিটেনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই ব্রিটিশ সরকার ও সচেতন নাগরিকদের একটি বিশাল অংশের এত উদ্বেগ। ব্রিটেনের বসতি সঙ্কট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে ডাক্তার ও নার্সের অভাব এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা শুধু সরকারের নয়, নাগরিকদেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণভোট। তাই এসব নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে গোটা ব্রিটেন। লাভ লোকসানের আলাপ-আলোচনা বিতর্কে সরগরম সমস্ত ব্রিটেন। এখন অপেক্ষা ২৩ জুন। [email protected]
×