ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রনি

গল্প ॥ সাদা মাকড়সা

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৯ এপ্রিল ২০১৬

গল্প ॥ সাদা মাকড়সা

সেই মাকড়সাটার শরীরের প্রায় পুরো অংশেই ছিল চুনের মতো সাদা রঙের গাঢ় একটা প্রলেপ মাখানো। তার কোমল দেহের ধূসর চামড়াটা ভেদ করে সাদা রঙের আভরণটা যে কবে জেগে উঠেছিল, তা একাধিকার দৃষ্টিপাত করেও খালি চোখে বুঝে ওঠা সহজ নয়। অথচ ক্ষুদ্রাকৃতির পতঙ্গটাই নিশোর শরীর বেয়ে ওঠার-কালে অদ্ভুত একটা সুড়সুড়ি লাগিয়ে তার বোধের নীরব সত্তাটাকে জাগিয়ে তুলল! নিজের কসুম-পেলব শরীর বেয়ে সাদা রঙের একটা মাকড়সাকে ছোটাছুটি করতে দেখেই নিশোর উপলব্ধি জাগল- রুহিনের হাত ধরে এভাবে পালিয়ে আসাটা মোটেই উচিত হয়নি। ক্ষুদ্রপ্রজ, মাকড়সার মতো একটা প্রাণী দেখে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ না থাকলেও, অজানা এক কালো অধ্যায়ের আগাম বার্তা পেয়েই যেন নিশোর শরীরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে আসল- -‘হায় খোদা! এ কী দেখছি আমি! আমার গায়ে সাদা মাকড়সা কেন! হায় হায় এটা কীভাবে সম্ভব?’ এক ঝটকায় মাকড়সাটা শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। তারপর খানিকটা নড়েচড়ে বসল। ততক্ষণে আঁচলের আঘাত পেয়ে ছিটকে পড়া মাকড়সা মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল- সেদিকে আর খেয়াল করার ফুরসত পেল না। তবে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে শূন্য ঘরে জনমানুষের অনুপস্থিতি টের পেয়ে বুকটা তার ধপ করে কেঁপে উঠল। কিন্তু চোখের পলকেই হারিয়ে যাওয়া মাকড়সা যেন তার শরীরের রং মিশিয়ে নিশোর মনের মধ্যে ভয়ানক একটা চিত্র এঁকে দিয়ে গেল। সেই চিত্রটা কিছুতেই মন থেকে আলাদা করতে পারল না নিশো। একেবারেই শিশির-ক্ষুদ্র একটা পতঙ্গের অঙ্গসজ্জা খুব দ্রুত নিশোকে চিন্তায় ফেলে দিল। টেনে নিল অতীতের পথে। তিন দিন হয়ে গেল রুহিনের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে সে। আশ্চর্য, এতদিনে একবারও মনে হয়নি ঘর ছেড়ে এসে বড় কোন অপরাধ করছে সে। তাছাড়া খুব দীর্ঘ সময় ধরে মন খারাপ হয়েছে এমনটিও তার উপলব্ধিতে আসেনি। পছন্দের মানুষের সঙ্গে পালিয়ে আসতে পারার সাফল্যে বরং ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছিল সে। তাহলে ছোট্ট একটা মাকড়সার শরীর দেখে ভেতরটা এত মোচড় দিয়ে উঠছে কেন? ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে বার বার। অনেক কষ্টে কান্না দমন করল। এমন সময় বিজলির চমকানোর মতোই নিশোর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি পরিবার। চমৎকার একটি গৃহ। পরম আদর-স্নেহে যেখানে সে বেড়ে উঠেছিল। রুহিনের সঙ্গে পালিয়ে এসে খুব সাদামাটা, জরাজীর্ণ একটা রুমে ভাড়ায় উঠেছে তারা। অথচ এতদিন একবারের জন্যও তার খারাপ মনে হয়নি কিছু। আশপাশে অচেনা-অজনা মানুষজনের বসতি দেখে উল্টো ভালই লেগেছিল। জীবনের পদে পদে রুহিনের ভালবাসার ছায়া কল্পনা করে করে সে অতীতকে বিসর্জন দিয়ে এসেছে। কেন যেন ভালবাসার ছায়াঘেরা সেই কুটিরটিই এখন পৃথিবীর আবর্জনাময় শ্রেষ্ঠ একটি নর্দমা বলে মনে হচ্ছে। বিশ্রী ডেরায় দম আটকে আসতে চাইছে। স্বল্প সময়ের জন্য আপন করে নেয়া চারদিকের পরিবেশ-প্রতিবেশের দিকে দৃষ্টিপাত করলে গলা বেয়ে বমি নেমে আসতে চাইছে। সারাটা জীবন নরম বিছানায় পিঠ রেখে রেখে কত স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করেছে নিশো! তাই আবেগমিশ্রিত প্রেমনিকেতনের মায়া তার বেশি দিন স্থায়ী হলো না। রুমের পাথরপ্রতিম বিছানায় এক মুহূর্তের জন্যও বসে থাকা ধাতে সইছে না। সীমাহীন অস্থিরতা আর অভাবনীয় ভয়ের মধ্যে রুহিনের নম্বরে ডায়াল দেয়া হলো। ভয়ের পরিধিটা বাড়িয়ে দিতেই যেন অপরপ্রান্ত থেকে মোবাইল বন্ধের বার্তা উড়ে এলো। বার্তার প্রশ্রয়ে ভয়ের দৈত্যটা আরও ভয়াল আর বীভৎস চেহারায় নিশোর সামনে এসে উপস্থিত হলো। কাজের সন্ধানে সেই যে কখন বেরিয়ে গেছে রুহিন- আর যোগাযোগ করেনি। অসময়ে তার ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এতক্ষণের চিন্তাটা বিরাট এক দুশ্চিন্তার জন্ম দিল। সদ্যজাত ভয় আর অসীম নিঃসঙ্গতা তাকে ব্যাকুল করে তুলল। ভয়ার্ত কণ্ঠে স্বগোতোক্তি ছাড়ল,- ‘তাহলে কী রুহিনের কিছু একটা...? না, না ওসব লক্ষ্মীছাড়া কথা যে মুখে আনাও পাপ!’ নিশোর চোখের সামনে ভয়াল পর্দাটা যখন ধীরলয়ে স্বাস্থ্যবান হচ্ছিল সে মুহূর্তেই রুহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। দুশ্চিন্তা আর জেদের যুগল মিশ্রণে নিশোর এখন খেই হারানো অবস্থা! নিজেকে আজ ফ্রান্জ কাফকার মেটামরফোসিস উপন্যাসিকার গ্রেগর সামসা নামের সেই নিঃসঙ্গ মানব-পোকাটার মতোই ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। ভেবে দিশকুল পাচ্ছে না সে, তাহলে কি শ্বেতাঙ্গ মাকড়সা তাকে বড় ধরনের কোন অশনি সঙ্কেত দিয়ে গেল! রুহিন কি খুব সহসাই...? না না এটা কীভাবে সম্ভব? সাদাসিধে একটা মাকড়সা, শ্বেতশুভ্র একটুখানি রং আর কিছু অতীত-ভাবনা নিশোর চোখের সামনে টেনে আনল কতোগুলো প্রিয় মানুষের মুখ। বিশেষ করে ঠাট্টা সম্পর্কের সেই ভাবি আর নানি-দাদিদের স্মৃতি হঠাৎ করেই তার ভাবনাকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তুলল। নিশোর স্পষ্ট মনে আছে, কিশোরীকালে একবার তার শরীর বেয়ে লালবর্ণের একটা মাকড়সা ওঠানামা করতে দেখে দাদিমার সে কি হাসি! সারাদিন কি সব ঠাট্টা-তামাশা করে বেরিয়েছেন তিনি,- ‘কিরে, কার লাগে? হু! এত তাড়াতাড়িই বিয়ের ফুল ফুইটা গ্যালো বুঝি। নতুন বউ হওয়ার লক্ষণ দিকি শরীল পাকনের আগেই ভাইসা উঠতাছে রে সতীন বোন! এই জন্যি তো কই সতীন আমার দিনরাইত পাড়ায় পাড়ায় নাগর খুঁইজা বেড়ায় ক্যারে।... হুম, হা হা।’ তারপর কি সব ঠাট্টা-মসকরা কথা! সেদিন লজ্জায় একেবারেই কুমড়োলতার মতো নেতিয়ে গিয়েছিল নিশো। আর দাদু-ভাই তো সেই থেকে নিশোকেই নিজের বউ বলে দাবি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। দিন কতেক বাদে বাজার থেকে ফিরে একসেট টুকটুকে লাল জামা এনে দাদু-ভাই আচমকাই তার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এ নিয়ে বাড়িতে সে কি হৈ চৈ! দৃশ্যপটটা কল্পনা করলে এখনও অদ্ভুত একটা আনন্দের স্রোত তার শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। মানুষের শরীরে মাকড়সার ওঠা-নামার সঙ্গে জামা-কাপড়, বিয়ে-শাদির যে কি সম্পর্ক প্রথমদিকে বিষয়টা নিশোর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকলেও পাড়ার সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে ইতোপূর্বে যথেষ্ট তালিমও পেয়ে গেছে সে। অন্যান্য মেয়েদের মতো তার মধ্যেও বিশ্বাস ঢুকে গেছে যে, মানুষের গায়ে যখন যেই বর্ণের মাকড়সা কিংবা প্রজাপতি উঠ-বস করবে অল্পদিনের মধ্যে সে অবিকল ওই রঙেরই কাপড়-চোপড় উপহার পাবে। অর্থাৎ নতুন পোশাকের পূর্ব-ইঙ্গিত নিয়েই মূলত মাকড়সা অথবা প্রজাপতিরা মানুষ জাতির শরীরে চড়ার সাহস পায়। শৈশবের সেই কোমল বিশ্বাসটাই নিশোর ভাবনার জগতটাকে সম্প্রসারিত করে দিচ্ছে। এখনও কানের পর্দায় বেজে উঠছে ঠাট্টা সম্পর্কের মানুষগুলোর মুখে মুখে বেঁচে থাকা অবৈজ্ঞানিক সেই কথামালার তীব্র-ডঙ্কা। নিশোর প্রচণ্ড ভয় হ্েচ্ছ। বিবাহিত জীবনের বয়স মাত্র তিনদিন হলো! একেবারেই স্বল্পায়ু সংসার। এর মধ্যে সাদা রঙের একটা মাকড়সা তার গা’চেপে বসে কি সাংঘাতিক একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছে- সে অর্থ মোটেই অজানা নয়! ভয়ে রক্ত চলাচলে ব্যাহত হচ্ছে। ভেবে কিনারা পাচ্ছে না কী এমন পাপ করল, যার কারণে এতা তাড়াড়াড়ি শরীরে তার সাদা মাকড়সা চাপল? এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিল! সাদা রং ব্যতীত অন্য যে কোন বর্ণের মাকড়সা যদি গায়ে চেপে বসতো আজÑ তাহলে সে মোটেই দুশ্চিন্তায় পড়ত না। কিশোরীকালের মতো আজকেও যদি সেই লাল রঙের মাকড়সাটাই তার শরীরের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঠত! মহাখুশিই হতো নিশো। কখনো মাকড়সাটাকে ওভাবে তাড়িয়ে দিত না। খুশিতে হয়ত দীর্ঘক্ষণ তাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখত। কিন্তু সাদা রঙের মাকড়সা গা বেয়ে ওঠা মানে তো নিশো সাদা শাড়ি উপহার পাচ্ছে! আর বিবাহিত মেয়েদের জীবনে সাদা শাড়ির অর্থ যে কি সাংঘাতিকÑ সে কথা বুঝে ওঠার জন্য রামায়ণ কিংবা বেদ পড়ার দরকার লাগে না। তাহলে কি অলুক্ষণে মাকড়সাটা নিশোকে অকাল বৈধব্যের পোশাক পরার ইঙ্গিত দিয়ে গেল! খুব সহসাই কি সে স্বামীহারা হতে যাচ্ছে? যে কোন মুহূর্তেই কি নিশো সাধারণ পোশাক ত্যাগ করে বিধবার পোশাক গায়ে জড়িয়ে নিতে হবে? কথাটা ভাবতে গেলেই গলাটা শুকিয়ে আসে। বিষয়টা কুসংস্কার ভেবে উড়িয়ে দিতে গিয়েও পারলো না। ভাবল, আগের কালের মানুষের মুখের কথাগুলো যদি এতটাই ভিত্তিহীন হতো তাহলে হাজার বছর ধরে এই কথার প্রচল থাকবে কেন। সত্যিই যদি রুহিনের কিছু হয়ে যায় তাহলে কাকে নিয়ে সে বাঁচবে? কার দরজায় গিয়ে ঠাঁই নেবে নিশো? কে তাকে আশ্রয় দেবে? বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার কি কোনো মুখ আছে তার? দুশ্চিন্তা আর হতাশার ভারি একটা পাথর নিশোর বুক চেপে ধরল। ঘিরে ধরল অতীতের কিছু স্মৃতিও। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার বোকামির কথাটা ভেবে নিজের যন্ত্রণাবোধটা আরো তাঁতিয়ে তুলল। সেদিন কেন যে এভাবে পালিয়ে আসল তারা? রুহিনের পরিবার আর নিশোর পরিবার মর্যাদার দিক থেকে তো প্রায় সমপর্যায়েরই ছিল। রুহিনও তো অনেক যোগ্যতাবান ছেলে। তাহলে বিষয়টা জানাজানি হলেই বা ক্ষতি ছিল কি? পরিবারের লোকজন জানলে হয়ত তাদের সম্পর্র্কটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিত। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কথাটা ভাবলে এখন প্রচ- লজ্জা। পালিয়ে আসার ভূতটা যে ঘাড়ে মাথায় চেপেছিল সেদিন! অনেক ভাবনা-চিন্তার মাঝখানে মা আর বাবার মুখটা ভেসে উঠল নিশোর চোখে। কত শান্তশিষ্ট মানুষ দুজন। বেশ আদরে, প্রশ্রয়ে বড় করেছিল নিশোকে। বড়-ভাই দুলালের মৃত্যুর পর সে আদর পড়েছিল নিশোর ওপরে। পূর্বের তুলনায় ঘরে তার যতœআত্তি এবং অধিকার খাটানোও বেড়ে গিয়েছিল। নিশোর সকল স্বেচ্ছাচারিতাকে সাদরে মেনে নিয়েছিল ঘরের সবাই। জীবনে কি সে অভাব অনুভব করেছে কখনও? তাহলে কেন হঠাৎ মা-বাবার মুখে এমনভাবে চুন-কালি মেখে দিল? ছোট-ভাই আকশটাও বোধহয় এতদিনে খেলার মাঠ পর্যন্তও মাড়ায়নি। সারাদিন নির্জন, নিশ্চুপে ঘরে বসে বসে অশ্রু ঝরাচ্ছে। অবাক হচ্ছে বোনের নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডের জন্য। প্রয়াত বড় ভাই দুলালের শখের কবুতরগুলোর মায়াও নিশোকে পেয়ে বসলো। ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পরে কবুতরগুলোর দেখভাল সে নিজেই করে এসেছিল এতদিন। সেই অবুঝ পাখিগুলোর দেখাশোনা করার কি এখন বাড়িতে কেউ আছে? বাড়ির সেই চওড়া উঠোনটি, যেখানে রোজ বসে বসে পাড়ার সঙ্গী-সাথিদের সাথে তার গল্প-আড্ডা হতো। সেই সুন্দর উঠোনটিও হঠাৎ নিশোর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল। এই মুহূর্তে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য কিছুটা অনুতাপও জাগ্রত হলো। চোখ ভিজে আসতে চাইল। মনে মনে ভাবল, সে পালিয়ে আসার পর তার বাবা বোধহয় আজ অবধি অফিসে সহকর্মীদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না। অথচ লোকে তাকে কতো সমীহটাই না করত! আর মাও বোধহয় এতদিনে পাড়ার প্রচ্ছন্ন শত্রুদের মুহুর্মুহু শব্দবাণে ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরছেন। আর নীরবে, নিভৃতে অভিশাপের গরল ঢালছেন নিশোর ওপরে। ছোট্ট আকাশটা কি এখন ঠিকমতো পড়তে বসে? কে তার পড়া ধরিয়ে দেবে? দুর্গার অকাল মৃত্যুতে অপু যেমন ধাক্কা খেয়েছিল তেমনি বোধহয় বড় বোন নিশোর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মূর্খতাও আকাশকে সীমাহীন দুঃখ দিয়েছে। বই-পাগল পিতার বুকসেলফ থেকে মাঝেমধ্যে সুন্দর সুন্দর কিছু বই নামিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছিল নিশোর। সেই সুবাদে একদিন বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসটি পড়ে নিয়েছে সে। ফলে, অনেকবারই অপু আর দুর্গার দুঃখবোধ কল্পনা করে করে নিশো চোখের পানি খসিয়েছে। তারপর তো নিজেকেই সে সাদামাটা মেয়ে দুর্গার প্রতিরূপ কল্পনা করতে বেশ পছন্দ করত। তাই ছোট-ভাই আকাশের সঙ্গেও তার গড়ে উঠেছে সীমাহীন সখ্যভাব। অবাধেই তারা হেসে খেলে কাটিয়েছে সময়। সেই সময়ের স্মৃতির রোদ্রকুয়াশা এখন নিশোর দিলটাকে আরো নাজেহাল করে দিচ্ছে। উষ্ণতায় ঘেরা শহুরে আলো-বাতাস নিশোর কাছে এতদিন বিশুদ্ধ অথবা পবিত্র মনে হলেও এখন তা অসহ্য লাগে। মাথার ওপর প্রচণ্ড গতিতে বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। অথচ সে ঘামে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঝিম ধরে আসছে মাথাটা। বুকের ভেতরটাতে চিনচিন করে উঠছে। শূন্যঘরটিতে এই প্রথম সে বাড়িতে ফেলে আসা আসবাবপত্রগুলোর অভাব অনুভব করল। মনের মাধুরী মিশিয়ে ওগুলো ঘরে সাজিয়েছিল সে। বিছানার উত্তর পাশের সেই বড় আলমিরাটা, আলমিরা লাগোয়া একটা পড়ার টেবিল, টেবিলের ওপর নিঃশব্দে পড়ে থাকা কিছু বইসহ ঘরের অসংখ্য অসবাবপত্রের স্মৃতির আগুন তাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে অস্থির করে দিচ্ছে। নিশো ভেবে অবাক হচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে তার পাষণ্ড-মন ওইসব জিনিসপত্রের মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে আসতে পারল! প্রতিদিন সন্ধ্যা-নাগাদ ঘরের দক্ষিণ পাশে শব্দহীন দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী তেঁতুল গাছটিতে বসে অবিরাম ডেকে যাওয়া সেই নাম না জানা পাখিটিও নিশোর ভাব্না এড়াতে পারল না আজ। বারবার মনে হচ্ছে, নিশো পালিয়ে আসায় সেই পাখিটিও বোধহয় অভিমান করে এখন আর সেই তেঁতুল গাছের সরু ডালটিতে এসে বসার প্রয়োজনীয়তা মনে করে না। সেই সঙ্গে মৃত ভাইয়ের কবরটির প্রতিও তার মায়া পড়ে গেল। ভাইয়ের কবরের সবুজ ঘাসগুলোও বোধহয় নিশোর পালিয়ে আসার দুঃসহসটা কল্পনা করলে আঁতকে ওঠে বার বার। বার বার মনে হচ্ছে, তার প্রকা- শরীরটা যেন আজ নির্ভার একটি মাকড়সার জালে আটকা পড়ে আছে। সে ঝুলে আছে অনিশ্চিত শূন্যতায়। সাধারণ শুভ্র-দেহী একটা মাকড়সা কী ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে জন্ম নিয়েছে যে সে আঁকড়ে ধরে রেখেছে নিশোর সর্বাঙ্গ। মাকড়সা আর প্রজাপতিকে ঘিরে চিরায়ত বাক্যগুলোর সত্যতা কখনই তলিয়ে দেখেনি নিশো। তবে রুহিনের ফোন বন্ধ থাকায় সে বিশ্বাসটা আরও প্রকটই হয়েছে। নিজেকে সে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। বহুকষ্টে কান্না চেপে রাখল। ভাবছে, রুহিনের কিছু হয়ে গেলে কাকে নিয়ে বাঁচবে সে? পৃথিবীর সবকিছু ত্যাগ করেই তো সে রুহিনের কাঁধে ভর করেছে। ইত্যাকার ভাবনায় নিমজ্জিত নিশো নিজেকে শান্ত করতে পারল না। দোরগোড়ায় দুর্যোগ ঘন ভয়ঙ্কর একটি মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে করে সে সজ্ঞাহীন অবস্থায় পতিত হলো। আসন্ন দুর্গতির ইঙ্গিত পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল নিশো। ফলে, নিজের সুন্দর-মসৃণ মুখমণ্ডনখানি সজোরে চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল সে। চোখের পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেল তার আঙ্গুল, গণ্ডদেশ। ধীরগতিতে সে পানি স্পর্শ করল তার বুকের জমিন। চোখ-নির্গত উষ্ণ-জলের ধারার কি আর সাধ্য আছে কারও বুকের যন্ত্রণার আগুন নিবৃত্ত করে রাখার! কাজেই, শূন্যঘরে নিশোর কান্নার শব্দটা অদ্ভুত একটা গোঙানির মতোই শোনা গেল। দৈবক্রমে অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এলো রুহিন। আনন্দচিত্তে। বাইরে থেকেই সে নিশোর নাম ধরে চেঁচাতে লাগল। ভাল একটা কাজের সন্ধান পাওয়ায়ই মূলত এত হৈ-হুল্লোড় করে তার বাসায় ফেরা। কিন্তু রুহিনকে দেখামাত্রই হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল নিশো। তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুহিনের বুকের ওপর। তার কান্নার আওয়াজও বেড়ে গেল দ্বিগুণ। দৃশ্যটা দেখেই হতবিহ্বল রুহিন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তার বিস্ফারিত চোখ নিশোর দিকে পুরোপুরি নিবদ্ধ হয়ে রইল। তাই কথা বলার ভাষা ও সাহস নিমিষেই সে খুইয়ে ফেলল। ফলে চাকরি পাওয়ার সুসংবাদটা আর দেয়া হলো না তাকে। নিশোর কান্নার তীব্রতাই রুহিনকে কথা বলতে বাধ্য করছে : -‘কি হয়েছে নিশো? একা একা ভয় লাগে?’ উত্তর করল এলো না। কান্নার ধ্বনিটা পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেল। -‘আহা কি হয়েছে বলবে তো? বাইরের কেউ বলেছে কিছু?’ কান্না থামল না। বার বার ফুঁপিয়ে উঠছে সে। কঁকিয়ে উঠছে বুক। পুনরায় জিজ্ঞেস করল। -‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’ বাক্যটা উচ্চারণ করেই নিশোকে বুক থেকে একটু আলগা করে কপালে হাত রাখল। নিশোর কোন অনুভূতিই বোঝা যাচ্ছিল না। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চাপাকান্না ইচ্ছে করেও সে থামিয়ে রাখতে পারছে না। -‘আরে কি হয়েছে না বললে বুঝব কীভাবে? হুম! যাই হোক, আমি চলে আসছি। আর ভয় নেই। এখন কান্না থামাও। লক্ষ্মী বউ। সুসংবাদ আছে! চাকরি একটা যোগাড় হয়ে গেছে। বেতনও খারাপ না। চিন্তা-ভাবনার আর কোন কারণ নেই। বাকি জীবনটা খুব সুখে-শান্তিতেই কাটিয়ে দিতে পারব। খুশি হওনি তুমি..? একটু হাসো প্লিজ...! বলো, আজ কি চাও? এখন যা চাইবে তা-ই পাবে। এবার একটু কান্না থামাও সোনা...’ নিশো কান্না থামানোর চেষ্টা করল। পারল না। তবে কান্নার ভয়ঙ্কর শব্দটা এখন আর নাই। রুহিনকে পুনরায় জড়িয়ে ধরে অবাক করে দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিশো বলে উঠল- -‘আমি বাড়ি যাব! রুহিন, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো!’ -‘মানে!’ রুহিন একটু হোঁচট খেলো যেন। সে কথাই বাড়াতে পারল না। শুধু নিশোর মুখের দিকে দীর্ঘ সময় ধরে পলকহীন তাকিয়ে রইল। কেন যেন আজ নিশোর অশ্রুসিক্ত চোখগুলোকে বার বার মনে হচ্ছে সদ্য সাগর সেঁচে আনা দুটি জীবন্ত ঝিনুক। আর ঝিনুকদ্বয়ের হাঁ- করা পেটের মধ্যে পড়ে আছে দুটি নিথর সমুদ্র। সেই সমুদ্রের নরম জলে টলমল করে ভাসছে দুটি মণিরতœ। রুহিন ভেবে পাচ্ছে না, ওই মণিরতœগুলো কি সে কুড়িয়ে এনে ঘরে তুলবে, নাকি অসীম সমুদ্রের সুগভীর জলরাশিতে তলিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
×