ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নৌদুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট জমাই হয় না ঠিকমতো

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নৌদুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট জমাই হয় না ঠিকমতো

রশিদ মামুন ॥ নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই সারাদেশে। দুর্ঘটনার পর পর বিষয়গুলো বারবার আলোচনায় এলেও এক মাসের মধ্যে সব কিছু হারিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে ঝুঁকি হ্রাসে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিটিএ), নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের (ডস) দুর্ঘটনা প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনও করেন না। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ মাসে সংঘটিত ১৩টি নৌদুর্ঘটনায় গঠিত (মোস্তফা-৩ দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত) ১৫ কমিটির আটটি তদন্ত প্রতিবেদন জমাই দেয়নি। অন্যদিকে বড় দুর্ঘটনার প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নও করে না সরকার। নৌ-নিরাপত্তাকে চরম অবহেলা করায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে আরও ৭০ জনের নাম। সর্বশেষ রবিবার মানিকগঞ্জের পদ্মায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে কার্গো জাহাজ এমভি নার্গিস-১ এর ধাক্কায় অন্তত ২২০ যাত্রীবোঝাই লঞ্চ এমভি মোস্তফা-৩ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অন্তত ৮০ জন বেশি যাত্রী পরিবহন করছিল। এর আগে গত ৪ আগস্ট মাওয়াতে ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত ১৩৫ যাত্রী পরিবহন করছিল। প্রায় সাত মাসের ব্যবধানে আবারও গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌবন্দরে কীভাবে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করার সুযোগ পায় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নৌযান ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকটি নৌযানের যাত্রী সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা দেখার জন্য বিআইডব্লিটিএ এবং ডসের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকবল রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হয়। জানা গেছে, রবিবার ডুবে যাওয়া এমভি মোস্তফা-৩ নৌযানটি সম্প্রতি ডসের খুলনা কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মোঃ শাহরিয়ার হোসেন পরিদর্শন করে কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করে। এর মধ্যে লঞ্চটির হ্যাজ কভার ওয়াটার টাইট ছিল না। ডস সূত্র বলছে ওয়াটার টাইট হ্যাজ কভার না থাকায় নৌযান দ্রুত ডুবে যায়। প্রতি চারজনের জন্য একটি করে লাইফ বয়া থাকার নিয়ম রয়েছে। লঞ্চটির ধারণ ক্ষমতা ১৪০ জনের জন্য ৩৫টি বয়া থাকার কথা। কিন্তু লাইফ বয়া ছিল মাত্র ২৩টি। প্রসঙ্গত বার্ষিক সার্ভে সনদ অনুযায়ী নৌযানটির দিনের বেলা শান্ত পানিতে ধারণ ক্ষমতা ১৪০ জন আর রাতের বেলা ৬২ জন। তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাৎসরিক ফিটনেস নেয়ার সময় প্রতিটি লঞ্চেই প্রশিক্ষিত মাস্টার এবং ড্রাইভারদের পোশাক পরে সার্ভেয়ারের সামনে উপস্থিত হওয়ার বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে তা মানা হলেও প্রশিক্ষিত ড্রাইভার এবং মাস্টার এমভি মোস্তফা-৩ চালাচ্ছিল না। তাদের বদলে ভিন্ন কেউ নৌযানটি চালাচ্ছিল বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। বিষয়টি আরও অনুসন্ধানের পর প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে। জানা যায়, দুর্ঘটনা পর গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর অধিকাংশই এখন তদন্ত করাও ছেড়ে দিয়েছে। আলোচিত ঘটনাগুলোর দায়সারা তদন্ত হলেও অন্যগুলো থেকে যায় অন্ধকারে। তদন্ত প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে বারবার। অন্যদিকে তদন্তপ্রতিবেদনের কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন হয় না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাম্প্রতিককালের বহুল আলোচিত সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে অয়েল ট্যাঙ্কার (তেলবাহী জাহাজ) ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ ও পদ্মার মাওয়ায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল পিনাক-৬, সবশেষ রবিবার এমভি মোস্তফা-৩ সহ গত ১০ মাসে সংঘটিত ১৩টি নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর (ডস) মোট ১৭টি কমিটি গঠন করলেও ইতোপূর্বের ১৫টির আটটি কমিটি-ই তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি। তদন্তের শেষ পর্যায়ে বিলুপ্ত করা হয় একটি কমিটি। আর মোস্তফা-৩ দুর্ঘটনার জন্য গঠিত দুটি কমিটি সবে কার্যক্রম শুরু করেছে। রবিবার বিকেলেই নৌযানটির তথ্য-উপাত্তা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ডস গঠিত তদন্ত কমিটি। গত ৯ ডিসেম্বর দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সুন্দরবনে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ দুর্ঘটনায় ওই দিনই ডস মহাপরিচালক অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ এর ৪৫ ধারা মোতাবেক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সংস্থার নটিক্যাল সার্ভেয়ার এ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহম্মেদকে আহ্বায়ক, পরিদর্শক মোঃ আবু জাফর মিয়াকে সদস্য সচিব এবং বিশেষ কর্মকর্তা (নৌ-নিরাপত্তা) ও নির্বাহী হাকিম গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসানকে করে সদস্য করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ১৫ কার্যদিবসের সময় বেঁধে দেয়া হয়। একই ঘটনা তদন্তে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নুর-উর রহমানের নেতৃত্বে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু দুই কমিটির কোনটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এর আগে গত ২৫ নবেম্বর রাতে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি বিউটি অব ইমা’র ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি নৌযান ডুবে যায়। এতে একজন নিহত হন। এর একদিন আগে ১৪ নবেম্বর ভোররাতে মংলা বন্দরের কাছে সুন্দরবনের ভেতরে পশুর ও শ্যালা নদীর সংযোগস্থল তামবুল বুনিয়ায় তলা ফেটে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শাহীদূত। দুটি ঘটনা তদন্তে ২৬ ও ২৫ নভেম্বর চার সদস্যবিশিষ্ট আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নির্ধারিত ১৫ কার্যদিবসের পর আরও সময় নিয়েও কোন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি কমিটি।
×