ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে মাছ কমছে ইলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ

অবৈধ ট্রলিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্র সম্পদ

আবুল হোসেন রাজু, কুয়াকাটা, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ২২:২৫, ২৯ জুলাই ২০২৫

অবৈধ ট্রলিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে সমুদ্র সম্পদ

বেহুন্দি জালের মাধ্যমে মাছের পোনা, ডিম এমনকি খাবারও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে

বঙ্গোপসাগরে অবৈধ ট্রলিং ট্রলারের মাধ্যমে ধ্বংস করা হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে মাছ, কমছে ইলিশসহ গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ। স্থানীয় জেলেরা এর জন্য দায়ী করছেন প্রশাসনের মদতে পরিচালিত অবৈধ যান্ত্রিক ট্রলিং বোটকে। জেলেদের অভিযোগ, সাধারণ কাঠের ট্রলারকে স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে যান্ত্রিক ট্রলারে রূপান্তর করে তাতে ছোট ফাঁসের নিষিদ্ধ ‘বেহুন্দি জাল’ যুক্ত করা হচ্ছে।

এই জালের মাধ্যমে মাছের পোনা, ডিম এমনকি খাবারও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে গত চার-পাঁচ বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে মাছের প্রজনন হার। এতে করে শুধু মাছ নয়, পুরো সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে ২৭ জুলাই সকাল থেকে কুয়াকাটার চৌরাস্তায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সাধারণ জেলেরা। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে কক্সবাজার, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় হাজারখানেক জেলে ‘সাধারণ জেলে ব্যানারে’ অংশ নেন।

মানববন্ধনে বক্তারা জানান, কুয়াকাটার আলীপুর ও মহিপুর এলাকার পাশাপাশি বরগুনার পাথরঘাটা থেকেও অন্তত ২০-৩০টি অবৈধ ট্রলিং বোট নিয়মিত এ এলাকায় মাছ শিকার করছে। যদিও পাথরঘাটায় প্রশাসন ট্রলিং বোটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে কুয়াকাটায় প্রশাসনের ভূমিকা নীরব ও ব্যর্থ বলে দাবি করেন জেলেরা। আলীপুরের জেলে সেলিম ফরাজী বলেন, ‘আমরা মাছ পাচ্ছি না, অথচ অবৈধ ট্রলিং বোটগুলো লাখ টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দিব্যি সাগরে মাছ শিকার করছে।

কুয়াকাটা নৌ-পুলিশ ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে ঘুষ দিয়ে তারা সবকিছু নির্বিঘেœ চালাচ্ছে। যদি সরকার চায়, তাহলে একদিনেই এগুলো বন্ধ করা সম্ভব।’ নোয়াখালীর জেলে আলম গাজী বলেন, ‘বেহুন্দি জালে হাজার হাজার মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে। মাছ বড় হতে পারছে না, উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে দিন দিন সাগর হয়ে পড়ছে মাছশূন্য।’ কুয়াকাটা ‘আশার আলো মৎস্য সমবায় সমিতির’ সভাপতি নিজাম শেখ বলেন, ‘একটি কাঠের ট্রলারকে ট্রলিং বোটে রূপান্তরে খরচ হয় ৩০-৪০ লাখ টাকা।

এই বেহুন্দি জালে পানি ছাড়া কিছুই বের হতে পারে না। পোনা, ডিম এমনকি প্ল্যাঙ্কটন পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’ এদিকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রাজিব সরকার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য এবং অবৈধ জাল ব্যবহারের ফলে ইলিশ ও অন্যান্য মাছের প্রজননে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সরকার যদি অবৈধ জাল উৎপাদন ও নিবন্ধনহীন ট্রলিং বোট বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়, তবে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।’

অভিযোগের বিষয়ে কুয়াকাটা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিকাশ ম-ল বলেন, ‘আমরা সব সময় সচেতন থাকি। তবে গভীর সমুদ্রে অভিযান চালাতে লজিস্টিক ঘাটতির কারণে সমস্যা হয়। বর্তমানে একটি মামলাও আদালতে চলমান রয়েছে।’ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনিত ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের দপ্তর সমুদ্রে ট্রলার পাঠায় না, অনুমতিও দেয় না। বরং কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে। 
কেউ কেউ আদালতে গিয়ে অবৈধ ট্রলার বৈধ করার চেষ্টা করছে। আমরা ইতোমধ্যে কোস্টগার্ডকে জানিয়েছি অচিরেই অভিযানে নামা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একটি মহল প্রশাসনকে হেয় করার চেষ্টা করছে।’ জেলেরা জানিয়েছেন, যদি সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে তারা আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাবেন।

প্যানেল হু

×