ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

মানবিক বিপর্যয়, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ

সাতক্ষীরায় পানিবন্দি শতাধিক গ্রাম

স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৬ জুলাই ২০২৫

সাতক্ষীরায় পানিবন্দি শতাধিক গ্রাম

জলাবদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শহরের নিচু এলাকার মানুষ মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন

গত দশদিন ধরে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না পানিবন্দি অসহায় মানুষগুলো। হাজার হাজার পরিবারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। ঘরে খাবার নেই। রান্না করার জায়গা নেই। কাঁচা আর আধাপাকা ল্যাট্রিনগুলো পানিতে ডুবে আছে। বাড়ির উঠানে হাঁটু পানি। নলকূপগুলো ডুবে আছে। বাথরুম করতে পারছে না। গোসল করার ব্যবস্থা নেই। কাঁচা পাকা পায়খানাগুলো পানিতে মিলে মিশে একাকার। খেটে খাওয়া মানুষদের কাজ নেই। মানুষের মনে স্বস্তি নেই।

গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের যোগাযোগের মাধ্যম প্রধান সড়কজুড়ে  এখনো পচা আর গন্ধযুক্ত পানি। টানা বৃষ্টির মধ্যে একদিন একটু রোদের দেখা মিললেও বুধবার দুপুরের পর থেকে আবারও ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধ পানির পরিমাণ বেড়েছে। পানিবন্দি এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ।  নৌকা, ভেলা আর বাঁশের সাঁকো বানিয়ে চলছে ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনেকে এখন বাড়ির মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। এ সকল অসহায় পরিবারগুলোতে চলছে বোবাকান্না। এই অসহায় আর বিপর্যয়ের চিত্র দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলার শতাধিক গ্রামজুড়ে। 
জলাবদ্ধতার বিপর্যয়ের কথা জানিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, বেতনা নদী দিয়ে পানি নামতে শুরু করেছে। নোয়াপাড়া থেকে ঝাউডাঙ্গা পর্যন্ত নদীতে কোনো ক্রস বাঁধ নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, পানিবন্দি প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার সরবরাহের জন্য বরাদ্দ চেয়ে তিনি জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছেন।

জলাবদ্ধতায় বেশি বিপর্যয় বেতনা নদীর অববাহিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৮ নং ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা, গোবিন্দপুর, বড়দল, দামারপোতা, কোমরপুর, সুপারিঘাটা, ধুলিহর সানাপাড়া, তেতুলডাঙা গ্রামগুলো। অকাল বন্যায় এসব গ্রামগুলো এখন দাঁড়িয়ে আছে পানির ওপর। রাস্তায় পানি, বাড়ির উঠোনে পানি, রান্নাঘরে পানি, টয়লেটে পানি, গোয়ালে পানি, শোবার ঘরে পানি, কবরস্থানে পানি, স্কুলে পানি, মসজিদে পানি, মাঠে পানি, খেতে-খামারে পানি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।

এভাবে পানিতে ভাসছে বেতনা পাড়ের শতাধিক গ্রাম। বেতনা নদীর খনন কাজ শেষ না হওয়ায় সামান্য কিছু পানি নিষ্কাসন হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। প্রখর রোদ আর বৃষ্টি বন্ধ ছাড়া পানি কমার  আপাতত কোনো পথ নেই বলে মনে করেন এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ। জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি হাজার হাজার পরিবারের এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে প্রতি বর্ষা মৌসুমে। আর এই বিপর্যয় চলে টানা ৬ থেকে ৮ মাসজুড়ে। পৌরসভাসহ সদর উপজেলার শতাধিক গ্রামের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম বেতনা নদী। নদী এখন বিল ছাড়া উঁচু হওয়ায় নদীর পানি বিলে এসে জমা হয়। কিন্তু বিলের পানি নদীতে যায় না।  

এ ছাড়া রয়েছে শহর ও গ্রামজুড়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ। ফলে পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথগুলো বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধ এলাকার পরিমাণ বাড়ছে। এদিকে প্রতিনিয়ত টানা ভারি বৃষ্টির কারণে এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের কাজ মিলছে না। ঘরে খাবার নেই। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ। সরকারি কলেজ রোড, পুরাতন সাতক্ষীরা, মাছখোলাসহ সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ ৪টি ইউনিয়নের ৬৩টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। প্রসূতি মায়েদের থাকার নিরাপদ জায়গা নেই।

বেশিরভাগ শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।  পচা আর বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা চর্মরোগসহ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর এই জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী রূপ নেওয়ায় এলাকায় হাজার হাজার পরিবারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানান, সদরের লাবসা, বল্লি, ব্রক্সমরাজপুর, ধুলিহর ইউনিয়নসহ এলাকার পানি নিষ্কাশন খালগুলো কাজ না করায় এবং অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ করায় নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমনকি পৌরসভার নিষ্কাশন চ্যানেলগুলো দখল করে মাছ চাষ করায় এমন বিপর্যয় বলে মনে করছেন নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ। 
এদিকে পরিস্থিতির অবনতিতে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। গোবিন্দপুর গ্রামের অনেক পরিবারের সদস্যরা জানান, গত কয়েকদিন তাদের বাড়িতে কোনো রান্না হয়নি, ঘরে চাল থাকলেও রান্না করার কোনো উপায় নেই। কোনোরকম চিড়ামুড়ি খেয়ে দিন পার করছে এ সকল পরিবারের সদস্যরা।  ঘরবাড়িসহ সবকিছু পানির নিচে।

গত দশদিন ধরে রান্নাবান্না বন্ধ থাকলেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। সংবাদকর্মীদের দেখলেই অসহায় পানিবন্দি গ্রামবাসীরা মনে করেন, হয়তো তাদের জন্য কেউ খাবার ও পানি নিয়ে আসছে।

প্যানেল হু

×