
মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা
১৬.০৭.২০২৫
গত দশদিন ধরে বাড়ি থেকে বের হতে পারছেনা পানিবন্দী অসহায় মানূষ গুলো। হ্জাার হাজার পরিবারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। ঘরে খাবার নেই। রান্না করার যায়গা নেই। কাাঁচা আর আধাপাকা ল্যাট্রিন গুলো পানি ডুবে আছে। বাড়ির উঠানে হাটু পানি। নলকুপ গুলো ডুবে আছে। বাথরুম করতে পারছেনা। গোসল করার ব্যবস্থা নেই। কাঁচা পাকা পায়খানা গুলো পানিতে মিলে মিশে একাকার। খেটে খাওয়া মানুষদের কাজ নেই । মানুষের মনে স্বস্তি নেই। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের যোগাযোগের মাধ্যম প্রধান সড়ক জুড়ে এখনো পচাঁ আর গন্ধযুক্ত পানি। টানা বৃষ্টির মধ্যে একদিন একটু রোদের দেখা মিললেও বুধবার দুপুরের পর থেকে আবারো ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধ পানির পরিমান বেড়েছে। পানিবন্দি এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পানি বাহিত রোগ।নৌকা, ভেলা আর বাঁশের সাঁকো বানিয়ে চলছে ঝঁকিপূর্ণ যাতায়াত।
পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অনেকে এখন বাড়ির মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। এ সকল অসহায় পরিবার গুলোতে চলছে বোবা কান্না। এই অসহায় আর বিপর্যয়ের চিত্র দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলার শতাধিক গ্রাম জুড়ে।
জলাবদ্ধতার বিপর্যয়ের কথা জানিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ বুধবার (১৬ জুলাই) বিকালে জনকন্ঠকে বলেন, বেতনা নদী দিয়ে পানি নামতে শুরু করেছে। নোয়াপাড়া থেকে ঝাউডাঙ্গা পর্যন্ত নদীতে কোন ক্রস বাধ নেই উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, পানিবন্দি প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার সরবরাহের জন্য বরাদ্দ চেয়ে তিনি জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছেন।
জলাবদ্ধতার বেশি বিপর্যয় বেতনা নদীর অববাহিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৮নং ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা, গোবিন্দপুর, বড়দল, দামারপোতা, কোমরপুর, সুপারিঘাটা, ধুলিহর সানাপাড়া, তেতুলডাঙা গ্রামগুলো। আকাশ বন্যায় এসব গ্রামগুলো এখন দাঁড়িয়ে আছে পানির উপর। রাস্তায় পানি, বাড়ির উঠোনে পানি, রান্নাঘরে পানি, টয়লেটে পানি, গোয়ালে পানি, শোবার ঘরে পানি, কবরস্থানে পানি, স্কুলে পানি, মসজিদে পানি, মাঠে পানি, ক্ষেতে-খামারে পানি। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। এভাবে পানিতে ভাসছে বেতনা পাড়ের শতাধিক গ্রাম। বেতনা নদীর খনন কাজ শেষ না হওয়ায় সামান্য কিছু পানি নিষ্কাসন হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। প্রখর রৌদ্র আর বৃষ্টি বন্ধ ছাড়া পানি কমার আপাতত: কোন পথ নেই বলে মনে করেন এলাকার ভুক্তভোগী মানুষেরা। জলাবদ্ধতায় পানি বন্দি এসকল হাজার হাজার পরিবারের এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে প্রতি বর্ষা মৌসুমে। আর এই বিপর্যয় চলে টানা ৬ থেকে ৮ মাস জুড়ে। পৌরসভা সহ সদর উপজেলার শতাধিক গ্রামের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম বেতনা নদী। নদী এখন বিল ছাড়া উঁচু হওয়ায় নদীর পানি বিলে এসে জমা হয়। কিন্তু বিলের পানি নদীতে যায় না। এ ছাড়া রয়েছে শহর ও গ্রাম জুড়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ। ফলে পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক পথ গুলো বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধ এলাকার পরিমান বাড়ছে।
এদিকে প্রতিনিয়ত টানা ভারি বৃষ্টির কারণে এলাকায় শ্রমজীবি মানুষদের কাজ মিলছেনা। ঘরে খাবার নেই । বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ বন্ধ। সরকারি কলেজ রোড, পুরাতন সাতক্ষীরা, মাছখোলা সহ সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ ৪টি ইউনিয়নের ৬৩টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে । প্রসুতি মায়েদের থাকার নিরাপদ যায়গা নেই। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পঁচা আর বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা চর্মরোগসহ পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর এই জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী রূপ নেয়ার এলাকায় হাজার হাজার পরিবারে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানান, সদরের লাবসা, বল্লি, ব্রক্সমরাজপুর, ধুলিহর ইউনিয়ন সহ এলাকার পানি নিষ্কাশন খাল গুলো কাজ না করায় এবং অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ করায় নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এমনকি পৌরসভার নিষ্কাশন চ্যানেল গুলো দখল করে মাছ চাষ করায় এমন বিপর্যয় বলে মনে করছেন নাগরিক কমিটির নেতৃবৃন্দ।
এদিকে পরিস্থিতির অবনতিতে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে গরু ছাগল, হাঁস, মুরগী নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে যাচ্ছে। গোবিন্দপুর গ্রামের অনেক পরিবারের সদস্যরা জানান-গত কয়েক দিন তাদের বাড়িতে কোন রান্না হয়নি, ঘরে চাল থাকলেও রান্না করার কোন উপায় নেই। কোন রকম চিড়ামুড়ি খেয়ে দিন পার করছে এসকল পরিবারের সদস্যরা। ঘরবাড়িসহ সবকিছু পানির নিচে। গত দশদিন ধরে রান্নাবান্না বন্ধ থাকলেও সরকারি বা বেসরকারীভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সামগ্রী । সংবাদ কর্মীদের দেখলেই অসহায় পানিবন্দি গ্রামবাসিরা মনে করেন, হয়ত তাদের জন্য কেউ খাবার ও পানি নিয়ে আসছে।
আঁখি