ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২

জুলাই গণঅভ্যুত্থান

আবু সাঈদের মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ, বেগবান হয় আন্দোলন

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৫ জুলাই ২০২৫

আবু সাঈদের মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ, বেগবান হয় আন্দোলন

আবু সাঈদের মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ

১৬ জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে যখন ছাত্র-আন্দোলন তুঙ্গে, তখন ১৬ জুলাইয়ের দুপুরে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের প্রতিভাবান ছাত্র ২৪ বছরের আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে মারা যান। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। 
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ এসএসসি ও এইচএসসিতে স্বর্ণপদক ও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। পরিবারের স্বপ্ন ছিল একদিন সে অনেক বড় হবে, যেভাবে টিউশনি করে পরিবারের দুঃখ মেটাচ্ছে, সেভাবেই একদিন পরিবারের হাল ধরবে। তবে সে স্বপ্ন মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় ১৬ জুলাই। শান্তিপূর্ণ কোটা আন্দোলনে  পুলিশের গুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে যায় তার। এ ঘটনায় ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। এরপরই কোটা সংস্কার আন্দোলন আরও জোরদার হয়।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আবু সাঈদ দুই হাত প্রশস্ত করে, ডান হাতে একটি লাঠি নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশের সামনে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট ও শটগান প্লেট ব্যবহার করে গুলি চালায়। এতে তার বুক, গলা ও কোমরে গুলি লাগে। একপর্যায়ে গুলির ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠীরা তাকে একটি রিক্সায় করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান। 
এছাড়াও এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন। আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। তাদের একজন হলেন বলাকা সিনেমা হলের সামনে অস্থায়ী দোকানের হকার মো. শাহজাহান (২৪)। আরেকজন হলেন নীলফামারী সদরের বাসিন্দা বাদশা আলী ও সূর্য বানুর ছেলে সবুজ আলী (২৫)।
এদিন শিক্ষার্থীরা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েন্সল্যাব, প্রগতি সরণি, শান্তিনগর, বাড্ডা, মতিঝিল শাপলা চত্বর, তাঁতীবাজার, উত্তরা ও বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। মহাখালীতে শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেও অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৃথক স্থানে ছাত্রলীগ ও কোটা আন্দোলনকারীরা সমাবেশ করেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নগরীর চাঁনখারপুল, পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার, প্রগতি সরণি, ভাটারা, মিরপুর-১০ এবং ফার্মগেট এলাকাতেও সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়।
এছাড়া চট্টগ্রামেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। নিহতরা হলেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম (২৪), ওমর গণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ (২৪) এবং একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক (৩২)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ওইদিনের দেশব্যাপী সহিংসতাকে ‘রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট দমন-পীড়ন’ হিসেবে আখ্যা দেন। আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ১৭ জুলাই দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৬ জুলাই রাতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও গাজীপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এছাড়া, সরকার দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে এবং ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ১৭ জুলাই সকাল থেকে নিজ নিজ ইউনিট অফিসে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। দলটি ঘোষণা দেয়, তারা রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনের মোকাবিলা করবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এদিন দেশের সাধারণ মানুষ ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ছাত্রদল আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছয়জন নিহতের ঘটনায় পৃথক বিবৃতিতে নিন্দা জানায় পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন। এছাড়া দেশের অন্তত ১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানান। ১৯৯০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারাও এক বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার ঘোষণা দেন।
একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের তিনটি হলকে ছাত্রলীগমুক্ত বলে ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শহিদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল এবং অমর একুশে হলে শিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। একই দাবিতে আন্দোলনে নামলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

এছাড়াও কবি নজরুল কলেজের এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সিএমএম কোর্টের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলেন মার্কেটিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের অনিক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ফেরদৌস।

প্যানেল হু

×