
দৈনিক জনকণ্ঠ
বয়স হয়ে গেছে, পা গুলি অচল হয়ে গেছে, আমি আর আগের মত নৌকা বাইতে পারি না। চার ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। নৌকা চালিয়ে সংসার চলে না বিদায় তিন ছেলেকে আস্তে আস্তে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় ছেলেটা ও মালদ্বীপ গিয়ে আর খোঁজ খবর নাই আর আসেও নাই। তাহার ছেলে-মেয়ে বউও আমার কাঁধে।
প্রতিদিন ফজরের সময় থেকে শুরু হয় আবার রাত হলে ঘরে ফিরি। অনেক লোক বিপদে পড়ে এসে ডাকাডাকি করে রাত্রের বেলা গাং (নদী) পার করে দেওয়ার জন্য।
নদীর বুকে সূর্য ওঠে, আবার রাতের আঁধারে মিলিয়ে যায়। সেই আলো-আঁধারির খেলা যেন প্রতিনিয়ত নতুন করে লিখে জীবন সংগ্রামের গল্প। এমনই এক গল্পের নায়ক ময়না মিয়া।
যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ভিটি বিশাড়া গ্রামের নিবেদিত প্রাণ এক মাঝি। ৫৩ বছর ধারে তিতাস নদীতে বৈঠা হাতে শুধু নৌকা চালান না, সাথে এগিয়ে নেন জীবনের পথ চলাও।
১৯৭২ সাল থেকে বৈঠা হাতে তিতাস নদীর বুকে ছুটে চলা মিজান মিয়ার রক্তে যেন মিশে গেছে এই পেশা। তিনি জানান, এখন অচল হয়ে গেছি বয়স হয়ে গেছে আর নৌকা বাইতে পারি না। গ্রামবাসীকে বললাম আমি আর পারি না অন্য কাউকে নৌকা চালাতে, এত কষ্ট করে কেউ আর রাজি হয় না।
যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে ততদিন লোক দিয়ে কাজ করায়। দৈনিক ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা ইনকাম করে অন্য লোককে কিছু দেই আমি কিছু রাখি।
রোদ, বৃষ্টি, ঝড় প্রকৃতির কোনো প্রতিকূলতাই থামাতে পারেনি তাকে। এই একটানা সংগ্রাম যেন এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত।
জীবনের পথচলায় এসেছে নানা বিপর্যয়। স্কুলের ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে নৌকা ডুবে যাওয়া, যাত্রীদের অবজ্ঞা, সমাজের অবহেলা স্বত্বেও দমে যাননি মিজান মাঝি।
মিজান মিয়া জানান, কোনোদিনও সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের মুখ দেখেননি। যেন নদীর মাঝেই ফেলে রাখা হয়েছে তাঁদের প্রাপ্য অধিকারগুলো, যা আর তীরে এসে পৌঁছায় না।
তার সহকর্মী অহিদ মিয়া বলেন, আমাদের জীবন চলে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় তুফানে‘। নৌকা চালিয়ে যেই টাকা পাই এই টাকা দিয়ে সংসারের বাজার খরচই হয় না। তিনি জানান, বছরের পর বছর নদীতে কাটিয়ে দেওয়ার পরও মাঝিদের সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছু নেই। অর্থাভাবে অনেক সময় সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের কাছে নৌকা চালানো শুধু একটি পেশা নয়, এ এক জীবনভর লড়াই।
তবুও তারা থেমে যান না। মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কষ্টের কথা চেপে রেখে প্রতিদিন চালিয়ে যান নৌকা। সেই নৌকার সঙ্গে বহন করেন জীবনের ভারও।
নৌকার মাঝি অহিদ মিয়া বলেন, ঝড় তুফানের সময় গ্যাংয়ের (নদী) দু' পাশে বাঁশের খুঁটি দিয়ে রশির বাধাগুলো ছিড়ে যায় তখন কচুরিপানা জন্য নাও(নৌকা) চালাতে পারি না। তখন যাত্রীদের ও হয়রানি আমাদের ও হয়রানি।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আয়েশ নুসরাত ভুঁইয়া বলেন, আমরা স্কুলে আসা যাওয়ার সময় ভয়ে আতঙ্কে থাকি কখন যে নৌকা ডুবে যায়। এখানে একটি ব্রিজ হলে আমাদের কষ্ট লাগব অনেকটা কমে যেত।
আরেক শিক্ষার্থী নিয়ামুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, আমরা এই নৌকা দিয়ে পারাপারের সময় অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। ঝড় তুফানের সময় আমরা স্কুলে আসা-যাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । এখানে একটি ব্রিজ হলে শিক্ষার্থীদের যেমন উপকার হবে জনগণের উপকার হবে।
স্থানীয় জনগণের মতে, মিজান মিয়া একজন পরিশ্রমে লোক। অনেক আগে থেকে দেখে আসছি উনি অনেক কষ্ট করে কচুরিপানার জন্য দুই পাশে বাঁশের খুঁটি ও রশি দিয়ে বাধ দিয়ে যাত্রী পারাপার করেন। এখানে একটি ব্রিজ হলে শিক্ষার্থী ও জনগণের আর কষ্ট হবে না।
হ্যাপী