ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফোটে চন্দ্র্র্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাসহ হরেক ফুল

এক যে আছে গোলাপ গ্রাম

অঙ্গন সাহা, সাভার

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১৩ মার্চ ২০২৩

এক যে আছে গোলাপ গ্রাম

সাভারে বাগান থেকে গোলাপ সংগ্রহ করছেন এক চাষি

১৯৮৯ সালের শেষের দিকে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের জমিতে প্রথম ফুল চাষ শুরু করেন মিরপুরের বাসিন্দা সাবেদ আলী। পরবর্তীতে তার ফুল চাষে সাফল্য দেখে উৎসাহী হয়ে ওঠেন স্থানীয়রা। আর এভাবেই গ্রামজুড়ে শুরু হয় ফুলের রানী গোলাপের চাষ। 
রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে তুরাগ নদের পাশেই সাদুল্ল্যাহপুর, শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ী, কাকাবো, ছোট ও বড় কালিয়াকৈরসহ কয়েকটি গ্রাম। গ্রামজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় গোলাপ। এ কারণে বর্তমানে গ্রামগুলো ‘গোলাপ গ্রাম’ নামেই মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। নব্বই দশকের আগেও তুরাগ নদ ঘেঁষা এ ইউনিয়নের ২০ থেকে ২৫টি গ্রামের কয়েকশ’ একর জমি পতিত ছিল। ঝোপঝাড় আর জঙ্গলে ভরা এসব জমি অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় সেচ সুবিধা তেমন না থাকায় চাষাবাদ হতো না বললেই চলে। 
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিরুলিয়া ইউনিয়নের ২৫০ হেক্টর জমিতে গোলাপ, জারবেড়া, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসসহ নানা জাতের ফুলের চাষ করা হয়। তবে এরমধ্যে বেশিরভাগই গোলাপ। এসব বাগানে প্রায় দেড় হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। আর প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরসহ আশপাশের এলাকাগুলো থেকে নানা বয়সী মানুষ গোলাপ বাগান দেখতে আসেন। মুগ্ধ হন গোলাপের সৌন্দর্যে। তাদের পদচারণায় মুখর থাকে পুরো গোলাপ গ্রাম।
ফুল চাষি সাবেদ আলী বলেন, ১৬ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে জাতীয় চিড়িয়াখানার এক পরিচালকের বাসভবনের সহকারী মালি হিসেবে কাজ শুরু করি। সেখানে সব ধরনের ফুল গাছের পরিচর্যা করতাম। তবে গোলাপের প্রতি তখন থেকেই ছিল বাড়তি আকর্ষণ। এ কারণে ভালো মতো গোলাপ চাষ ও পরিচর্যার পদ্ধতি রপ্ত করি। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে সাদুল্ল্যাহপুর এলাকায় ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরু করি।

প্রথমদিকে স্থানীয়দের এ বিষয়ে তেমন ধারণা না থাকায় অনেকেই উপহাস করতেন। কিন্তু যখন আমার বাগানের প্রচুর গোলাপ ফুটতে শুরু করে এবং তা রাজধানীর শাহবাগের পাইকারি বাজারে ভাল দামে বিক্রি করছি, এর পরই তাদের টনক নড়ে। পরবর্তীতে স্থানীয়রাও ফুল চাষে আগ্রহী হন। সাবেদ আলী আরও বলেন, বর্তমানে আমি প্রায় চার বিঘা জমিতে চায়না গোলাপ, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ কয়েকটি আইটেমের ফুলের চাষ করছি। 
গোলাপ চাষি আব্দুল ওয়াহব বলেন, সাবেদ ভাইয়ের হাত ধরে এ গ্রামে প্রথম গোলাপের চাষ শুরু হয়। আমিও প্রায় ২৫ বছর যাবত ২০ শতাংশ জমিতে গোলাপ চাষ করছি। এতে আমার আর্থিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। 
 গোলাপ চাষি মোক্তার হোসেন বলেন, এক সময় সবজির চাষ করলেও সবজি চাষে আশানুরূপ লাভ না হওয়ায় অন্যান্য ফুল চাষির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গোলাপের চাষ শুরু করি। প্রথমে এক বিঘা জমি নিয়ে গোলাপের চাষ করলেও বর্তমানে আমি পাঁচ বিঘা জমিতে নিয়মিত গোলাপের চাষ করছি। গোলাপ চাষে খরচ ও কষ্ট কম এবং লাভ বেশি। 
চাষিরা জানান, প্রথমদিকে ঝাকা বোঝাই করে তুরাগ নদে খেয়া পার হয়ে রাজধানীর কাটাবনে ভোরে ফুল নিয়ে যেতেন তারা। ২০১১ সালের পর থেকে বিরুলিয়ার ছোট কালিয়াকৈরে প্রতিরাতে বসে ফুলের বিরাট হাট। এক বাজারে সম্ভব না হওয়ায় পরে কয়েক কিলোমিটার দূরে মোস্তাপুর গ্রামে শুরু হয় আরেকটি হাট। যেখানে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা ফুল কিনতে আসে। 
বিকেলে গোলাপখেত থেকে ফুল কেটে তা প্রথমে বাড়িতে নেওয়া হয়। পানি দিয়ে তা টাটকা রাখা হয়। এর পর সন্ধ্যা হলে স্থানীয় বাজারে সেগুলো বিক্রি করা হয়। আর এ বাজার চলে সন্ধ্যা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত। বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, ভালবাসা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে বাজারগুলোতে গোলাপের চাহিদা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তারা আরও জানান, গ্রামগুলোর কাছে এয়ারপোর্ট থেকে যদি ফুলগুলো সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করা যেত তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। 
যেভাবে যাবেন গোলাপ গ্রাম ॥ রাজধানী ঢাকার পাশের উপজেলা সাভারের তুরাগ নদের তীরে অবস্থিত বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্ল্যাপুর (গোলাপ গ্রাম)। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে আপনি গাবতলী আসতে পারেন। এর পর গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে যেকোনো বাসে সাভার বাসস্ট্যান্ডের ওভারব্রিজের নিচে নামতে হবে। ওভারব্রিজ পার হয়ে পূর্বদিকের বিরুলিয়া ইউনিয়নের রাস্তায় রিক্সাসহ বিভিন্ন পরিবহনে মাত্র ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পৌঁছে যাবেন গোলাপ গ্রামে। 
এছাড়া মিরপুর শাহআলী মাজারের সামনে কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে আকরান বাজার। আকরান বাজার থেকে রিক্সায় ফুলের বাজারে কিংবা সাদুল্ল্যাহপুর গ্রামে যাওয়া যাবে। অন্যদিকে আবদুল্ল্যাহপুর/উত্তরা থেকে আসতে চাইলে আশুলিয়া রোড দিয়ে বিরুলিয়া ব্রিজে নামতে হবে। ব্রিজ থেকে রিক্সা অথবা মিনিবাসে  আকরান বাজার থেকে যেকোনো পরিবহনে সাদুল্ল্যাহপুর গ্রাম।

×