
ছবি: সংগৃহীত
একসময় যারা আন্তর্জাতিক ম্যাচে পা রাখতেই ভয় পেত, আজ তারা এশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদার টুর্নামেন্টে খেলার টিকিট কেটে ফেলেছে। একসময় যারা অনুশীলনের জন্য জুতাও পেত না, তারা আজ ইতিহাস গড়ছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মায়ানমার পরাজিত করে। বঞ্চনার দেয়াল টপকে, ঘাম আর অশ্রুর প্রতিদানে, আজ নারী ফুটবল দল জবাব দিয়েছে মাঠে, পরিসংখ্যানে, পারফরম্যান্সে।
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রথমবারের মতো এএফসি নারী এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিয়েছে। ইতিহাস বললেই যেন কম বলা হয়। কারণ, এটি শুধুই একবারের সাফল্য নয়—এটি একটি যুদ্ধ, একটি যাত্রা, একটি লড়াইয়ের একটি গল্প, যেখানে প্রতিটি লড়াই ছিল নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য।
এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে বাহরাইনকে ৭-০ এবং স্বাগতিক মায়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূল পর্বে উঠেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এমন প্রতিপক্ষ, যাদের র্যাংকিং আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। অথচ সেই দলের সামনে লড়াই নয়, আধিপত্য দেখিয়েছে ঋতুপর্ণারা। কোচ পিটার বাটলারের নেতৃত্বে এই দলটা শুধু কৌশলে নয়, মনোভাবে বদলে গেছে।
তবে এই জয়টা হঠাৎ করে আসেনি। এটি বহু বছরের বঞ্চনা, অবহেলা আর সংগ্রামের ফল। এই মেয়েরা সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা অনুশীলনের সময় ঠিকঠাক জুতা পেত না, যাদের বলা হতো “মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলো কেন?”, যারা খেলার জন্য পরিবার, সমাজ এমনকি নিজের স্বপ্নের সঙ্গেও লড়েছে। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্রের একেকজন সৈনিক, যারা জয়ের চেয়ে বাঁচার জন্য লড়েছে। তিন মাস বেতন না পেলেও টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়ন হলো সর্বশেষ টুর্নামেন্টেই। যে পারিশ্রমিকটা দেওয়া হয় সেটাও অনেক কম। আবার সেই অল্প পারিশ্রমিক দিতেও বিলম্ব করতে দেখা যায়। বাফুফে নিজেও জানিয়েছে বিনা পয়সার আবাসন ও খাবারের বিনিময়ে এই দলটা দেশের জন্য খেলছে। এই দলটার অনেকেই প্রান্তিক অঞ্চল থেকে এসেছেন। তাদের কেউ বাবাকে হারিয়েছেন, কেউ ভাইকে, মায়ের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে এসেছেন খেলতে। কেউ বোনের গহনা বিক্রি করে মাঠের খরচ জুগিয়েছেন। এত সমস্যা জর্জরিত এ দলটা এখন এএফসি এশিয়ান কাপে খেলবে। এটা সম্ভবত বাংলাদেশের ফুটবলের জগতে সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি। কেননা এর আগে কেবল একবারই পেরেছিল বাংলাদেশ এএফসি এশিয়ান কাপ খেলতে, ১৯৮০ সালে কুয়েতে ছেলেরা।
তাদের গল্পে শুধু জাতীয় দলের সাফল্য নেই, আছে হাজারো ঘরোয়া লড়াই। দেশের নানা প্রান্তে যারা ফুটবল খেলে যাচ্ছে, যাদের কেউ জানে না, চেনে না, তারাও এই লড়াইয়ের অংশ। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে যারা সুযোগ পায় না, যারা লিগের অভাবে খেলেই না, তারাও তো স্বপ্ন দেখে একদিন লাল-সবুজের জার্সিতে মাঠে নামার। অথচ ছেলেদের ফুটবলে যেখানে নিয়মিত লিগ, ট্রায়াল, একাডেমি, স্পন্সর সবই আছে, সেখানে মেয়েরা খেলছে নিজের খরচে, নিজের সাহসে। এই বৈষম্য নিয়েই তারা এগিয়েছে। গতবার তো এই আসরে অংশগ্রহণই তো করতে পারল না বাফুফের টাকার অভাবে।
এমন বাস্তবতায় ঋতুপর্ণাদের সাফল্য যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—ছেলেরা ৪৫ বছরে পারেনি যে ইতিহাস গড়তে, মেয়েরা এতো অল্প সময়ে কীভাবে করতে পারলো? এ কি শুধুই খেলার কৌশল, নাকি মানসিকতার বিপ্লব?
এই নারী দলটি তৈরি হয়েছে অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে। পিটার বাটলারের মেয়েদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল না প্রথম দিকে। বাফুফে যখন নতুন মেয়াদে আবার বাটলারকে নিয়োগ দিল, তখন তো বিদ্রোহ করে বসলেন খেলোয়াড়রা। ওই দল থেকে পরে কোচ ৫ জনকে ছাঁটাই করে নতুনভাবে শুরু করলেন। বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের দলে নিলেন। পিটার বাটলার এই প্রতিভাগুলোকে মসৃণ করেছেন, সাহস দিয়েছেন। পরে কোচ এবং খেলোয়াড়দের সাথে সম্পর্কও হয়েছে দারুণ। ওই দল নিয়ে যখন বাটলার শুরু করলেন, তখন দুইবার ৩-১ গোলে পরাজিত হলো বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ আরব আমিরাতের বিপক্ষে। কোচের ভাবনা ছিল—দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবসময় তো ভালো করছেই। তখন জর্ডান, সৌদি আরবের বিপক্ষে ড্রয়ের ফলে বিশ্বাস করেছিলেন বাংলাদেশের এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করবে এবং সর্বশেষ সেটাই হলো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সাফল্য কতটা স্থায়ী হবে? এর পেছনে কি যথাযথ ক্রীড়া কাঠামো গড়ে উঠেছে? নাকি এটি শুধুই প্রতিভার ঝলক? দেশের নারী ফুটবলে লিগই তো নেই। আছে জাতীয় দলের কিছু ম্যাচ, আর ফেডারেশনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে আয়োজন। এর বাইরে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে নারী ফুটবলের কোনো ধারাবাহিকতা নেই। স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও মেয়েদের খেলা নেই বললেই চলে। অথচ নারী ফুটবলের যে রোমাঞ্চ, তা এখন দর্শক টানছে। প্রয়োজন শুধু পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা। নেই নিয়মিত নারী ফুটবল লিগ, নেই উন্নত ট্রেনিং সেন্টার, নেই বাণিজ্যিক স্পন্সরশিপ। জাতীয় দলের বাইরে খেলোয়াড়রা খেলার মতো মঞ্চই পায় না।
এই সময়টাই এখন উন্নয়নের। বাফুফে চাইলে এখন এই সাফল্যকে মূলধন বানিয়ে নারী ফুটবলের জন্য ৫ বছরের একটি পরিকল্পনা নিতে পারে। নিয়মিত লিগ আয়োজন, বয়সভিত্তিক একাডেমি, প্রতিটি বিভাগে নারী ফুটবল টিম গঠন, সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করলেই এই সাফল্য শুধু থেমে থাকা গল্প হবে না, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণার মাইলফলক হয়ে থাকবে।
দেশের নারী খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা, মানসিক সহায়তা, শিক্ষাগত সহায়তা, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং—এসব এখন সময়ের দাবি। শুধু “জয়” বললে হবে না, জয় ধরে রাখার ভিত গড়তে হবে। তাদের জন্য আলাদা ফিজিও, ট্রেনার, স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট, পুষ্টিবিদের প্রয়োজন এখনই।
সবশেষে বলতে হয়, এই মেয়েরা আমাদের গর্ব। তারা জিতেছেই না, তারা জিতেছে একটি জাতির শ্রদ্ধা। মাঠে তারা যেমন লড়েছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে, মাঠের বাইরে তারা লড়েছে সমাজের চোখ রাঙানির সঙ্গে।
এই জাতি একদিন তার নারী ফুটবলারদের হাত ধরেই হয়তো বিশ্বমঞ্চে এক নতুন পরিচয় খুঁজে পাবে। আজ আমাদের দায়িত্ব, এই মেয়েদের কৃতজ্ঞতা জানানো। তাদের প্রতি জাতি হিসেবে একটাই কথা—ধন্যবাদ, ঋতুপর্ণারা।
তোমাদের মতো সাহসী হৃদয় আমাদের গর্ব।
মুমু ২