ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

বিশ্ব ক্রিকেটের বিস্ময় আফগানিস্তান

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ২৬ জুন ২০২৪

বিশ্ব ক্রিকেটের বিস্ময় আফগানিস্তান

মঙ্গলবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার পর আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

অদম্য আফগানিস্তানের জন্য কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়। বিনোদনের নির্মল মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গন। সেখানে ক্রিকেট দিয়ে তারা জয় করে নিয়েছে গোটা দুনিয়ার মানুষের হৃদয়। নানা কারণে বিধ্বস্ত দেশটি কয়েক বছর ধরেই অসাধারণ ক্রিকেট উপহার দিয়ে চলেছে। এরই ধারবাহিকতায় এবার চলমান টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে এসেছে আফগানরা। 
মঙ্গলবার সুপার এইটের শেষ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশকে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে ৮ রানে হারিয়েছে আফগানিস্তান। এই জয়ে অস্ট্রেলিয়াকে পেছনে ফেলে সেরা চারে এসেছে রশিদ খানের দল। ১৬ বছর আগেও যে দেশটি আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড ডিভিশন ফাইভ-এ খেলত, সেই দলটিই এখন শিরোপা জয়ের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। আফগানদের অতিমানবীয় পারফরমেন্সকে কোনো বিশেষণ দিয়েই শেষ করা যাবেনা। দুর্দান্ত, দুর্দমনীয়, ঐতিহাসিক- এমন অনেক কথাই আসছে।

কিন্তু সবকিছুই যেন তাদের প্রশংসার জন্য কম হয়ে যাচ্ছে! তারা এমন এক গ্রুপ থেকে সেমিতে এসেছে যেখানে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিপক্ষ ছিল। ভারত তিন ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে আগেই। লড়াইটা ছিল অস্ট্রেলিয়া আর আফগানিস্তানের মধ্যে। বাংলাদেশও ছিল। সমীকরণের প্যাঁচে টাইগারদেরও দারুণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু নেতিবাচক মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ লক্ষ্যপূরণ তো দূরে থাক; জিততেও পারেনি। শান্ত-সাকিবদের হারিয়ে  ইতিহাস গড়েছেন নবী-রশিদরা।

এর আগে মুখোমুখি দেখায় অস্ট্রেলিয়াকে ২১ রানে হারিয়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছিল আফগানরা। এরপর ভারতের কাছে অস্ট্রেলিয়া হেরে যাওয়ায় সেমির টিকিট পেতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেবল জিতলেই চলত আফগানদের। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আফগানিস্তান করতে পারে ১১৫ রান। স্বল্প সংগ্রহ নিয়েই বুক চিতিয়ে লড়াই করে আফগানরা। আর তাতেই শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি আইনে বাংলাদেশকে ৮ রানে হারিয়ে ইতিহাস লিখেছেন রশিদ-নবীরা। এর ফলে বাংলাদেশ তো বটেই, অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নও ভেঙেছে আফগানিস্তান। বাংলাদেশ যখন সেমির শর্তপূরণ করতে ব্যর্থ হয় তখনো ম্যাচটি জিতে গেলে অজিরা সেমিফাইনালে উঠে যেত।

কিন্তু আফগানরা জয় পাওয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে অস্ট্রেলিয়ারও। আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক অর্জনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন রশিদ খানরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে আফগান বন্দনা। সেখানে আফগানদের প্রশংসায় মেতে উঠেছেন সমর্থক থেকে শুরু করে সাবেক ক্রিকেটাররাও। পিছিয়ে নেই আইপিএলের দলগুলোও। আফগানিস্তানের সেমিতে যাওয়াকে নতুন যুগের সূচনা বলছেন অনেকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ ভারতের সাবেক ক্রিকেটার বীরেন্দর শেবাগ বলেছেন, ‘ওয়াও, আফগানিস্তান। কী দারুণভাবে সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়েছে ওরা! নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে। একেই বলে উন্নতি। অভিনন্দন।’ আইপিএলের দল দিল্লি ক্যাপিটালসের টুইটার পেজ থেকে দুটি ছবির কোলাজ শেয়ার করা হয়েছে। এখানে একটি ছবিতে লেখা, ‘২০০৮- বিশ্ব ক্রিকেট লিগের পঞ্চম ডিভিশনে খেলত।’ অন্য ছবিতে দেওয়া, ‘২০২৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে।’

এই দুটি ছবির কোলাজে ক্যাপশনে দিল্লি লিখেছে, ‘ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা আন্ডারডগ। আফগানিস্তান ক্রিকেটে নাম লেখাতে এসেছে।’ আইপিএলের আরেক দল চেন্নাইয়ের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ইতিহাস মনে রাখবে। আফগানিস্তান আসছে’ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু লিখেছে, ‘ইতিহাস এই দিনটাকে মনে রাখবে। নতুন যুগের সূচনায় আফগানিস্তানকে অভিনন্দন। যোগ্য সেমিফাইনালিস্ট।’ অথচ এই পথচলার পেছনে কতই না সংগ্রামের গল্প লেখা আছে। 

অসুস্থ মাকে ঘরে রেখে আসা রহমানউল্লাহ গুরবাজ, শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা গুলবাদিন নাইব, একটা দেশের ক্রিকেটকে একাকী নাবিকের মতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোহাম্মদ নবী। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বৈদেশিক সামরিক আগ্রাসন যাদের বিধ্বস্ত করে রেখেছিল দুই দশকের বেশি সময়, তারাই এখন বিশ্বক্রিকেটের মঞ্চে পতাকা উঁচিয়ে ধরেছে সগৌরবে। দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে অস্ট্রিয়া কিংবা মঙ্গোলিয়ার মতো দেশের বিপক্ষেও ক্রিকেট খেলেছেন মোহাম্মদ নবী।

দফায় দফায় অধিনায়ক হয়েছেন, সমসাময়িক সবাই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নবী যেন এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। নওরোজ মঙ্গল, দৌলত জাদরান কিংবা শাপুর জাদরানদের সঙ্গে ক্রিকেট শুরু করেছেন। এখন খেলছেন রশিদ খান, মুজিব উর রহমানদের সঙ্গে। মোহাম্মদ নবীর এই গল্পটা ক্রিকেট ছাড়া আর কে এত পূর্ণতা দিতে পারত! নিজেদের বাড়ি নেই, জীবন নেই, বাতাসে বুলেট আর বোমার তীব্র গন্ধ, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আফগান ক্রিকেটের পোস্টারবয় হয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলেছেন। আফগানিস্তান ক্রিকেটকে যেন নিজের কাঁধে নিয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বে। 
সেই ফলাফলটাই এবার পেয়েছেন নবী। বেলায় বেলায় অনেকটা সময় পার করেছেন। পারফরম্যান্সে ভাটা পড়েছে। তবু দলে আছেন। ভাগ্যিস ছিলেন! নয়তো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল নামের এমন অনিন্দ্য সুন্দর এক উপাখ্যান কী দেখতে পেতেন? রহমানউল্লাহ গুরবাজের কথাই বলা যাক। এই ম্যাচেও আফগান ব্যাটিং লাইনআপকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ কদিন আগেই অসুস্থ মাকে দেখে এসেছেন হাসপাতালে।

কিন্তু মা আর দেশ তো একইসূত্রে গাঁথা। গুরবাজ খেললেন দেশের জন্য। উগান্ডা ম্যাচে একবার আহত হয়েছিলেন। তবু খেলা ছাড়েননি। এবারের বিশ্বকাপে ইব্রাহিম জাদরানকে নিয়ে তিনবার শতরানের পার্টনারশিপ গড়েছেন। এক আসরে এতটা ধারাবাহিক ছিলেন না কোনো ওপেনারই। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচেও শেষ পর্যন্ত ছিলেন না তিনি। ইনজুরির কারণে উঠে গিয়েছিলেন মাঠ থেকে। কিন্তু ম্যাচ জয়ের পরেই তার কান্না বুঝিয়ে দিয়েছিল এমন এক জয়ের জন্য বহু রাতই নিজের জীবনকে শাসিয়েছিলেন এই ব্যাটার। 
গুলবাদিন নাইবের জীবনটা আরও বেশি রঙিন। আফগানিস্তানের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিকার তিনি। শরণার্থী শিবিরে ১১ বছর পার করার পর একসময় জানতেন না নিজের নামটাও। সেই ধ্বংসস্তূপের জীবনে ক্রিকেট এলো অক্সিজেন হয়ে। বাঁচার তাগিদে ব্যাট আর বলেই ভরসা রেখে চলেছেন পুরোদমে। তবে সেটাও তো খুব একটা সহজ ছিল না। বাধ্য হয়ে পারিবারিক ব্যবসায় পর্যন্ত নামতে চেয়েছিলেন। সেই মানুষটিই ক’দিন আগে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছেন; দলকে টেনে নিয়েছেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত।

বোমা আর বারুদের গন্ধ থেকে উঠে আসা আফগানিস্তানের ক্রিকেটের গল্পটা কোনো উপন্যাসের রোমাঞ্চের চেয়েও কম না। জীবনের গল্পটাই যেখানে জিতে যায় বারবার। ক্রিকেট নামের নিছক একটা খেলা যেখানে সামরিক অস্ত্রের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আফগানিস্তান সেই খেলাটাই খেলেছে জীবন দিয়ে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল সেই অসাধারণ জীবনের গল্পের একটা অধ্যায় মাত্র। এর চেয়ে বড় কিছুও হয়তো সামনে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। বুক চিতিয়ে লড়াই করা এই বীরেরা এবার বিশ্বমঞ্চে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

×