
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কাছ থেকে ট্রফি গ্রহণ করছেন লিওনেল মেসি, পাশে কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি
প্রথম সুযোগ এসেছিল ২৪ বছর পর, ২০১৪ সালে। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগাতে না পারায় লিওনেল মেসি পুড়েছেন হতাশার তীব্র অনলে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় লা আলবিসেলেস্তেরা। আবারও নীল বেদনায় আচ্ছন্ন হন রুপালি পবর্তমালার দেশের এমএল টেন। ভক্তরা শঙ্কায় পড়ে যান ২০২২ বিশ্বকাপ নিয়ে, তখন মেসির বয়স হবে ৩৫; তখন কি মেসির ফর্ম-ফিটনেস থাকবে? আর খেললেও কি বিশ্বকাপ জেতার অপূর্ণতা ঘোঁচাতে পারবেন? প্রায় দশকের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে যিনি ৩৭টি ক্লাব ট্রফি, সাতটি ব্যালন ডি’অর পুরস্কার এবং ছয়টি ইউরোপীয় গোল্ডেন বুট জিতেছেন।
একটি কোপা আমেরিকা খেতাব, একটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকও ছিল, শুধু বাকি ছিল অধরা বিশ্বকাপ। ভক্তদের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে মেসি অবশেষে পারলেন, অবশেষে স্বপ্নের আরাধ্য বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু দিতে পারলেন, যা ছিল তার সারাজীবনের স্বপ্ন। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর পুরনো একটি বিতর্ক আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে- মেসিই কি সর্বকালের সেরা ফুটবলার?
আগে তর্ক হতো, পেলে না ম্যারাডোনা সেরা? পরে তর্ক হয় পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মধ্যে কে সেরা? আরও পরে তর্কের নতুন বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর মধ্যে কে সেরা? এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, মেসি নামটা প্রায় বারবারই এসেছে। তার সিভিতে একমাত্র অবশিষ্ট শূন্যতা ছিল একটি বিশ্বকাপ জয়।
রবিবার রাতে লুসাইল স্টেডিয়ামে শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে আর্জেন্টিনা তৃতীয়বারের মতো এবং মেসি প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পান। ম্যাচে জোড়া গোল করার পাশাপাশি টাইব্রেকারেও গোল করেন এই আর্জেন্টাইন বিস্ময় জাদুকর। বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি গোল্ডেন বলও জেতেন। গড়েন আরও হাফ ডজনের মতো রেকর্ড।
ফাইনালে ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপের জাদুকরী হ্যাটট্রিকও মেসির নিয়তিকে বদলে দিতে পারেনি। এমনকি তখন তাকে বিচলিতও করতে পারেনি। পরে মেসি বলেছিলেন, ‘আমি জানতাম ঈশ্বর আমাকেই বিশ্বকাপ জেতাবেন।’ মেসি কি আসলেই সর্বকালের সেরা? চলুন এ ব্যাপারে সাবেক ফুটবল গ্রেটরা কে কি বলেছেন শোনা যাক। ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার বলেছেন, ‘প্রায় দুই দশক ধরে লিওনেল মেসিকে দেখা একটি পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
শ্বাসরুদ্ধকর, আনন্দময় ফুটবলের মুহূর্তের পর মুহূর্ত। তিনি ফুটবল ঈশ্বরের উপহার।’ ইংল্যান্ড মিডফিল্ডার ডেক্লান রাইস বলেছেন, ‘লিওনেল মেসিই সর্বকালের সেরা। তার মতো খেলোয়াড় আমরা আর দেখতে পাব না।’ আজেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, ‘মেসি বিশ্বকাপের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন। মেসিই শ্রেষ্ঠ। পেলের তিনটি বিশ্বকাপ জয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও এই ব্রাজিলিয়ান আইকনের ক্লাব ক্যারিয়ার মেসির তুলনায় ফ্যাকাশে। ম্যারাডোনা শুধু একটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, ইউরোপে ক্লাব ক্যারিয়ারে অনেক বছর খেললেও তিনি কখনো ইউরোপিয়ান কাপ জিতেননি।’
তবে পাল্টা যুক্তি হচ্ছে পেলে-ম্যারাডোনারা এমন এক যুগে খেলেছিলেন, যেখানে খেলোয়াড়দের অনেক কম সুরক্ষা দেয়া হতো। যেটা এখন মেসি-রোনাল্ডোরা যথেষ্ট পান। ম্যারাডোনার সাবেক সতীর্থ জর্জ বুরুচাগা বলেন, ‘মেসি ম্যারাডোনার চেয়ে কম বা কম নয়। মেসি ইতিহাসে থাকবেন। গত ৭০ বছরে পাঁচ ফুটবলার আছেন যাদের বিশ্বের সেরা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এরা হলেন : আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, পেলে, ইয়োহান ক্রুইফ, ম্যারাডোনা এবং মেসি।’ আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ বলেছেন, ‘মেসির মতো সর্বকালের সেরার সঙ্গে খেলতে পারাটা আমাদের নিয়তি। তার হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিতে পেরে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছে।’
ইতিহাস সাক্ষীÑ মেসিই প্রথম নন, যিনি একবার ফাইনাল খেলে পরে আর বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনিসহ মোট ১৬ ফুটবলার আছেন, যারা বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে প্রথমে ব্যর্থ হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে ঠিকই বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এ যেন বাংলা কবিতার সেই লাইনের মতো, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার’-এর মতো!
পরাজয় মানেই ব্যর্থতা নয়। আর ব্যর্থতাই হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি। মেসি ২০১৪ আসরে ব্যর্থ হলেও ২০২২ আসরে অবশেষে সফল হলেন। প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে পরে বিশ্বকাপ জয়ের এই তালিকায় আছেন জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, সেপ মেয়ার, হর্স্ট-ডাইটার হোয়েটেজ, জুর্গেন গ্রাবোস্কি, উল্ফগ্যাংগ ওভার্যাথ, পিয়েরে লিটবারস্কি, লোথার ম্যাথাউস, রুডি ভোলার, মিরোসøাভ ক্লোসা; ইতালির দিনো জফ, ব্রাজিলের কার্লোস জোসে কাস্তিলহো, রবার্তো কার্লোস, রিভাল্ডো, ডেনিলসন ও ডিডা। সবশেষে মেসি, যিনি কি আসলেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার?