ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কবি ॥ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কবি ॥ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

‘যে কবিতা শুনতে জানে না সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে। যে কবিতা শুনতে জানে না সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। যে কবিতা শুনতে জানে না সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।’ কবিতা শোনার মানসিকতা যার নেই, তাকে সরাসরি ছুড়ে ফেলেছেন কবি। কবির এই সাহস অদম্য। সত্যিই তো যে কবিতা শুনতে জানে না সে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত। কবিতা আমাদের মুক্তির পথ দেখায়। কবিতার এক একটি চরণ স্বপ্ন দেখায় অসম্ভবকে জয় করার। অথৈ সাগরে যুদ্ধবিদ্ধস্ত নাবিকের কাছে কবিতা জীবন বাঁচানোর একখ- শক্ত পাটাতন। কবি এ কবিতায় ক্রীতদাসের প্রসঙ্গ এনেছেন। যথার্থ সে প্রসঙ্গ। সেই সময়ে তাদের হাতে তো আমরা ক্রীতদাসের মতো বন্দী ছিলাম। কত সহজ ভাষায়, কত গভীরের কথাগুলো বলেছেন কবি। কবিতা ছাড়া কি এসব সম্ভব? কবির স্বার্থকতাই যেন এখানে। খুব সহজ ভাষায়, গভীরের অনুভূতি যিনি প্রকাশ করে গেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালপুরুষ, একুশের প্রথম সংকলনে লেখা ‘কোন এক মাকে’ কবিতার কবি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতা ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ এবং ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভা-ারে অভূতপূর্ব সংযোজন। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করেছিল, তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে এবং শহীদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ’৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকা-ে, মিছিলে, মিটিংএ তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। ’৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কোন এক মাকে’। বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছিল ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়। খোকা, যে শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনও উড়কি ধানের মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, মা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতার শরীরে ও সত্তায় প্রবহমান শহীদের রক্ত-নিংড়ানো আবেগ, যে-আবেগের ধারাজলে স্নাত হয় বাঙালী। গ্রাম থেকে আগত এক তরুণের মৃত্যুবেদনাই এই কবিতার মূল বিষয়। সাদামাটা উপমা। রূপকল্পে স্বরবৃত্তের বাঁধন। বর্ণনায় নেই অতিকথন, নেই এলিয়ে পড়া ভাব। টানটান ভঙ্গিতে বর্ণনা করে গেছেন মায়ের অনুভূতিকে। ছেলের ভালো লাগার আর ভালোবাসার বিষয়গুলোকে কবি বর্ণনা করেছেন সহজ সুরে। শব্দের অর্থদ্বৈততা নেই, নেই সাঙ্কেতিকতা বা রূপকের জটিলতা। সহজ সরল বর্ণনা। কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবিদের একজন। ভাষা আন্দোলন ছিল তাঁর কাব্য রচনার মূল প্রেরণা। পঞ্চাশের দশকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রধানত লিখতেন ছড়া। এই সময়ে তিনি কিছু বিদেশী কবিতারও অনুবাদ করেছেন। বেশ কয়েক বছর ছড়ায় নিজেকে প্রকাশ করার পর তিনি কবিতার মূলধারায় কাজ করতে শুরু করেন। গদ্যকবিতা তাঁর উচ্চারনের অবলম্বন হয়ে দেখা দেয়। ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ থেকে তাঁর কাব্যে আসে নতুন বাঁক। দীর্ঘ এই কবিতাটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আবিষ্কার করেন নতুন এক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে। কবিতাটি অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারপর একই ধারায় আমরা পেতে থাকি ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ এবং ‘আমার সময়’ এর মতো চমৎকার কবিতা। দেশ, কাল এবং ঐতিহ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা ব্যক্তির সঙ্কট, সংগ্রাম ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে উঠে এসেছে। কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বৈশিষ্ট্য কৌশল তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন ব্যবহার করে। তিনি লোকজ ঐতিহ্য ব্যবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। শব্দকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাজিয়ে কবিতা লেখায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ঢং। তিনি তাঁর কাব্যরীতিতে মূলত দুটি প্রবণতাকে অনুসরণ করেছেন : একটি তাঁর প্রথম জীবনের প্রিয় গীতিমুখ্য কাব্যরীতি আর অন্যটি মহাকাব্যিক। আশির দশক থেকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মহাকাব্যিক কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের চৈতন্যের জাগরণে কবি তুলে ধরেছেন প্রত্যয়দীপ্ত শব্দমালায়। সমবেত বাঙালীর আত্মজাগরণে তিনি লিখেছেনÑ ‘যে দিন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করল সেদিন আমরা প্রাচীন সঙ্গীতের মতো ঋজু ও সংহত হলাম পর্বতশৃঙ্গের মতো মহাকাশকে স্পর্শ করলাম, দিক চক্রবালের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে সমূলে উৎপাটিত করলাম সেদিন আমরা সমবেত কণ্ঠে কবিতাকে ধারণ করলাম।’ মুক্তিযোদ্ধা সেই অমর কিংবদন্তি যতটা আবেগ ও বাস্তবতায় কবিতা লিখতে পারেন আমরা সাধারণরা তার কতটুকুই বা পারি? তার বলাটা কবিতার মতোই যুগান্তকারী। আপোসহীন কঠিন সময়ের তিনি উচ্চারণ করেছেন চরম বাস্তবতার কথা। কবিতার প্রতি কত নিগূঢ় ভালোবাসা থাকলে এত জীবন্ত, সাহসী, অবিনাশী বক্তব্যের গতিময়তা উপস্থাপন করা যায় কবি তাই দেখিয়েছেন। ১৯৩৪ সাল। ব্রিটিশ সামরাজ্যের সূর্য তখন পটে বসছে। বিশ্বের দিকে দিকে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবিতে ব্রিটিশ শোষণে অতিষ্ঠ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির ডামাডোল পেরিয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব যখন এক অস্থির আশঙ্কায় কম্পমান। তখনই সেই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জেলাশহর বরিশালে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। ব্রিটিশযুগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পাকিস্তান যুগে যৌবন এবং বাংলাদেশে দেখেছেন নিজের পরিণতি ও সফল পরিসমাপ্তি। ত্রিকালদর্শী এই মহতী পুরুষ, মহান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রায় এক বছর অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
×