ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

ডিজিটাল ক্লিকের ফাঁদে দিশেহারা মানুষ

সোহাইল আহমেদ, কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক

প্রকাশিত: ১৯:২৪, ৬ মে ২০২৫

ডিজিটাল ক্লিকের ফাঁদে দিশেহারা মানুষ

ছবি: সংগৃহীত

এক সময় মানুষ অন্যের মুখে শুনে গুজব বিশ্বাস করত। এখন মানুষ নিজের হাতেই তা ছড়িয়ে দেয়, কখনো না বুঝে, কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে। সময় বদলেছে, বদলেছে গুজবের রূপ, প্রতারণার কৌশল, বিশ্বাসের সংজ্ঞা। আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে প্রতারণা আর গুজবের ভয়াল ছায়া আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা প্রতিটি বার্তা যেন সম্ভাব্য এক ‘ফাঁদ’, যেখানে একবার পা রাখলেই সর্বনাশ অনিবার্য।

একটি ক্লিক, একটি ক্ষতি

“আপনার এনআইডি বাতিল হতে যাচ্ছে”, “অমুক কোম্পানি দিচ্ছে পুরস্কার”, “এই লিংকে ক্লিক করুন ও ৫০০ টাকা জিতুন”-এসব মেসেজ এখন অগণিত মানুষের ইনবক্সে প্রতিদিনের অতিথি। অদ্ভুত হলেও সত্য, এখন আর প্রতারণা করতে ছুরি বা বন্দুক লাগে না, লাগে শুধু ইন্টারনেট কানেকশন আর কিছু ভুয়া লিংক। মানুষ যতই আধুনিক হচ্ছে, প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা যতই বাড়ছে, এই প্রতারণার ফাঁদ ততই প্রসারিত হচ্ছে।
প্রতারকরা আমাদের দুর্বলতা চেনে-আমাদের লোভ, কৌতূহল, অজ্ঞতা আর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। তারা জানে, অল্প কিছু পয়সা, এক টুকরো মোবাইল রিচার্জ কিংবা চাকরির প্রলোভনে কত মানুষ চোখ বুজে সব দিয়ে দিতে রাজি। তাইতো ফেসবুকে ছদ্মবেশী আইডি থেকে হুট করেই কেউ বলছে, “আমি আপনার পুরোনো বন্ধু”; তারপর শুরু হয় ‘বিকাশে টাকা পাঠান’, ‘একটু হেল্প করুন’ ধাঁচের নাটক। বহু মানুষ বিশ্বাস করে ফাঁদে পড়ে।

গুজবের আগুনে পুড়ে ছাই সমাজ

অনলাইন গুজব এখন শুধু নির্দোষ হাস্যরসের বিষয় নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে সমাজবিধ্বংসী অস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক লাইভে এসে কোনো ব্যক্তি যদি বলে, “অমুক ধর্ম অবমাননা করেছে” বা “এই গ্রামে ডাকাত পড়বে”—তাহলে মুহূর্তেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়, এবং প্রায়ই তা প্রাণহানিতে গিয়ে ঠেকে।
একটি ভুয়া ভিডিও, একটি বিকৃত ছবি, একটি উসকানিমূলক বক্তব্য—এসবের পেছনে ছুটে চলে হাজারো মানুষ। কারণ মানুষ দেখছে, না ভেবে, না যাচাই করে। কখনো তা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতার খেসারত দিতে হয় নিরপরাধ মানুষকে। একেকটা গুজব যেন আগুনের ফুলকি, যা মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে আগ্নেয়গিরির মতো।

বিশ্বাস হারাচ্ছে ডিজিটাল জীবন

বিশ্বাস এক সময় মানুষের মূল্যবান সম্পদ ছিল। এখন তা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য জিনিস। যে ফেসবুক বন্ধু ৫ বছর ধরে ‘হ্যালো’ বলেছে, সে-ই একদিন টাকা চায়। যে ইউটিউব চ্যানেল ১ লাখ সাবস্ক্রাইবারের কথা বলে, সে-ই পণ্যের রিভিউ দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝায়। বিশ্বাসের জায়গায় আজ এসেছে সন্দেহ, সতর্কতা আর আতঙ্ক। প্রযুক্তির অন্ধ ভালোবাসা মানুষকে করেছে বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, এবং একা।

তবে কি প্রযুক্তি অভিশাপ?

না, প্রযুক্তি নিজে অভিশাপ নয়। অভিশাপ আমরা নিজেরাই বানিয়েছি আমাদের অসচেতন ব্যবহার দিয়ে। প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে জ্ঞান, গতি, বিশ্বজয় করার হাতিয়ার। কিন্তু আমরা যদি সেই হাতিয়ার ভুল পথে চালাই, তাহলে ফল ভয়াবহ হবেই। তাই দরকার প্রযুক্তি ব্যবহারে সঠিক দিকনির্দেশনা, শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক বিবেক।

সমাধানের পথ-সচেতনতা, শিক্ষা, শৃঙ্খলা

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো গণসচেতনতা এবং ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার। আমাদের পরিবারে, বিদ্যালয়ে, মাদ্রাসায়, এমনকি বাজারেও ‘সাইবার সচেতনতা’ ছড়িয়ে দিতে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে-যেকোনো বার্তা বা লিংক বিশ্বাস করার আগে যাচাই করতে হয়। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে-আপনার সন্তানের হাতে থাকা স্মার্টফোন যেন তাকে ‘স্মার্ট’ করে, ‘নিশ্চিন্ত’ নয়।
সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজন আরও শক্তিশালী।

সাইবার মনিটরিং ইউনিট

যারা প্রতারকদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনবে। একইসঙ্গে ভুয়া আইডি, ফেক নিউজ বা গুজব ছড়ানো চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই-এই দুর্বলতা আমাদের সমাজকে অকার্যকর করে তুলছে।
গণমাধ্যমগুলোরও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে এখন 'ভিউ' বাড়ানোর নেশায় যাচাই না করেই গুজব ছড়ায়, শিরোনামে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এই মানসিকতা পরিবর্তন না হলে সমাজে অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি আরও বাড়বে।

আমাদের কী করণীয়?

প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। কোনো কিছু শেয়ার করার আগে ভাবুন-এটা সত্য তো? এটা কারো ক্ষতি করতে পারে কি না? আপনি যদি একটি মিথ্যা বার্তা না ছড়ান, তাহলে অন্তত একজন প্রতারকের হাত থেকে একজন নিরীহ মানুষ রক্ষা পাবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন শুরু হয় একজন মানুষ থেকে। আপনি হতে পারেন সেই পরিবর্তনের সূচনা। আপনার দায়িত্ববোধ, সচেতনতা, আর সিদ্ধান্তই পারে এই ডিজিটাল বিষবৃক্ষের বিষ প্রশমিত করতে।

আমরা এক অদ্ভুত দুনিয়ায় বাস করছি-যেখানে বাস্তবতা ফিল্টার দিয়ে সাজানো, আর মিথ্যে মুখোশে হাসছে বিশ্বাস। এই দুনিয়াকে সত্যের আলোয় ফেরাতে দরকার যুক্তির আগুন, বিবেকের চেতনা, এবং সচেতন সমাজ। অনলাইন প্রতারণা আর গুজবের এই যুগে চোখ বুজে নয়, চোখ খুলে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করাই আমাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্জন হবে। 

আসিফ

×