
.
এ বছরের ১৫-১৮ সেপ্টেম্বর হয়ে গেল ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কনভেনশন। সংক্ষেপে শব্দের আদ্যক্ষর দ্বারা IBC নামে পরিচিত। এটি একটি বার্ষিক বাণিজ্য প্রদর্শনী। যা গণমাধ্যম ও সম্প্রচার সংশ্লিষ্টদের জন্য সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে RAI প্রদর্শনী ও কনভেনশন সেন্টারে ৪ দিন ব্যাপি অনুষ্ঠিত হয়। এটিতে সাধারণত সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের নতুন প্রযুক্তি এবং সেই সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যক সুযোগ সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেরও এবার আই.বি.সি তে অংশগ্রহণ ছিল। IBC এর স্লোগান হল “By the industry, for the industry” একটি স্বাধীন সংস্থা, যার বর্তমান মালিক ছয়টি অংশীদার সংস্থা, যথা-IABM, IEEE, IET, RTS, SCTE এবং SMPTE।
এটি গণমাধ্যম ও সম্প্রচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠান যেমন, সম্প্রচারকারী, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক, পেশাদার, প্রযুক্তিগত সমিতি ও সম্প্রচার, বিনোদন এবং প্রযুক্তি শিল্পে অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে হয়। IBC-তে সহস্রাধিক দর্শনার্থীদের বাণিজ্য প্রদর্শনী ছাড়াও, একটি পরিপূর্ণ সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত হয়। যেখানে প্যানেল আলোচনা, ডেমো, প্রযুক্তিগত গবেষণামূলক নথি উপস্থাপনাসহ স্পিকার সেশন থাকে।
১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মকালে যখন টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি ইউরোপে প্রথম রঙিন টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে (উইম্বলডন ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টের বিবিসি সম্প্রচারের মাধ্যমে) তখন ইএমআই-এর জন টাকার, মার্কোনির টম মায়ার এবং দ্য র্যাঙ্ক অর্গানাইজেশনের জন ইথারিজ নামক এই তিন ব্যক্তির উদ্যোগে ‘By the industry, for the industry’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ওইঈ তার যাত্রা শুরু করে। বিশ্ব সেই বছর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি পরিপূর্ণ টিভি মিডিয়া শিল্পকে দেখেছিল। ইভেন্টটি লন্ডনের রয়্যাল ল্যাঙ্কাস্টার হোটেলে চালু হয়েছিল, যেখানে ২৪ টি দেশের শিল্প পেশাদাররা অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে IBC লন্ডন থেকে ব্রাইটনে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৯২ সালে ব্যাপক আন্তর্জাতিক ও বহুমাত্রিক পরিবহন এবং আতিথেয়তা অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে স্থানান্তরিত হয়। ২০২০ ও ২০২১ এই দুই বছর কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারির কারণে IBC-র ইভেন্টসমূহ ভার্চুয়ালি পরিচালিত হয়।
গত ৫৬ বছর ধরে IBC মিডিয়া এবং বিনোদন প্রযুক্তির বিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশ্বজুড়ে শিল্প ধারণা বিনিময় এবং উদ্ভাবন প্রদর্শনের জন্য একত্রিত হয়ে ফোরাম গঠন করেছে। সেই সঙ্গে এটি শিল্পের একাধিক মাইলফলকের সাক্ষী হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬৮ সালে চাঁদে নীল আর্মস্ট্রংয়ের প্রথম পদক্ষেপের সরাসরি বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার, ১৯৭২ সালে বিশ্বের প্রথম পে-টিভি নেটওয়ার্ক হিসেবে হোম বক্স অফিস (HBO) চালু করা, সনি ১৯৮৬ সালে IBC-তে প্রথম ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার প্রদর্শন করে, ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম হাইডেফিনেশন (HD) প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্প্রচার, ২০০৫ সালে YouTube নামে একটি নতুন ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট তৈরি করে এবং জাপানের NHK ২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিকের 8K কভারেজ অফার করে।
এবছরে IBC-তে ১৩ টি প্রদর্শনী হলের অভ্যন্তরে ১৭০ টিরও বেশি দেশ থেকে আসা প্রায় ৪৩ হাজার দর্শনার্থী ও প্রায় ১২৫০ টির মতো প্রযুক্তি নির্মাণ ও বাণিজ্যিক প্রদর্শনী প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেন। এখানে ৩২৫ জনের অধিক বিশেষজ্ঞ টেকনোলজি, ব্যবসা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের মধ্যে সামিরা বখতিয়ার (পরিচালক গ্লোবাল মিডিয়া এন্ড এন্টারটেইনমেন্ট, অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস) তার বক্তব্যে বলেন, “ আই.বি.সি গুরূত্বপূর্ণ কারণ এটি সবাইকে একত্রিত হওয়ার জন্য একটি স্থান প্রদান করে। আপনি যখন গ্রাহক ও অংশীদারদের সাথে একত্রিত হতে সক্ষম হন, তখন আপনি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে ও ধারণা করতে সক্ষম হন যা সাধারণত বেড়িয়ে আসে না। এটি ব্যাবসায়ের জন্য ভালো এবং আমরা যাদের পরিসেবা দিয়ে থাকি, তাদের জন্যও ভালো।” সুতরাং, সেই অর্থে এটিকে একটি পরিপূর্ণ বিষয়বস্তু, গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি বিষয়ক মার্কেটপ্লেসও বলা হয়ে থাকে।
আই.বি.সি থেকে বাংলাদেশের অর্জন ও সম্ভাবনা : আমাদের দেশ তথ্য-প্রযুক্তিতে দিন দিন অনেক উন্নতি সাধন করছে। তবে, আই.বি.সি তে অংশগ্রহণ আমাদের জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। সাথে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তির মান উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এছাড়াও অনেক দেশের প্রতিণিধিদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকার ফলে বাংলাদেশের সাথে তারা বাণিজ্যে আগ্রহী হলে তা আমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকেও ইতিবাচক সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে।
মার্কেটিং এবং জনসংযোগ: IBC সরাসরি প্রদর্শনীতে ব্র্যান্ডের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত সুযোগ তৈরি করে।
বিষয়বস্তুর সুযোগ: IBC-তে টেকনোলজি সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করাসহ নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়। এখানে কনভেনশনে একত্রিত হওয়ার পাশাপাশি সারা বছর ধরে তৈরি হওয়া নতুন ও অভিনব সামগ্রী প্রদর্শন করার সুযোগ হয়।
স্পনসরশিপ: IBC হলো একটি প্ল্যাটফর্ম যা কন্টেন্ট ও পণ্যের ব্র্যান্ডকে আন্তর্জাতিক স্পন্সরদের সঙ্গে পরিচিত করার একটি ভাল সুযোগ তৈরি করে।
নেটওয়ার্কিং সুযোগ: এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পণ্য যাচাইসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মুখোমুখি দেখা, আলোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেকটা ওয়ান স্টপ সলুশনের মতো একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে।
এবছরে ক্লাউড, এআই, ৫জি, ভিআর/এআর/এক্সআর, মেটাভার্স, গেমিং এবং এজ কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো শো ফ্লোর থিয়েটার এবং প্রদর্শনী হলজুড়ে কেন্দ্রে ও সামনে এগিয়ে ছিল।
IBC ২০২৩ এ জুরি বোর্ডের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিল্পে নেতৃস্থানীয় প্রদর্শনকারীদের প্রধান সারিতে স্থান পেয়েছে: Amagi, ARRI, AWS, Blackmagic Design, Bridge Technologies, Canon Europe, Cisco, Comcast, Deluxe, EBU (European Broadcasting Union), Evertz Microsystems, EVS Broadcast, Fraunhofer Digital Media, Google, Grass Valley, Gravity Media, Harmonic, HP, IMAX, Lawo, LTN, MediaKind, Microsoft Corporation, NEP Group, Orange, Prime Focus, Riedel Communications, Ross Video, Samsung, Sennheiser, Sony, Tata communications, Telestream, Vizrt গ্রুপ এবং Zixi.
উল্লেখযোগ্য কন্টেন্ট প্রোটেকশন এবং সিকিউরিটি সিস্টেম প্রদর্শনকারীদের মধ্যে CryptoGuard, Varimatrix, Irdeto, Nagra|
IBC কে কেন্দ্র করে গোটা আমস্টারডামে ছিল একটি উৎসব মুখর পরিবেশ। হোটেল রেস্তোরাঁ সর্বত্র ছিল বিদেশী অতিথিদের পদচারণায় ব্যস্ত। আয়োজক কমিটি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট, রেল ও বাস স্টেশন থেকে IBC স্থলে বিদেশী অতিথিদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে শাটল বাসের সার্ভিস চালু করেছিলেন। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন রুটে চলাচল করার জন্য সরকারি ট্রাম, ট্রেন ও বাসের টিকেট বিনামূল্যে সরবরাহ করেছেন।
আয়োজক কমিটি আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৩-১৬ সেপ্টেম্বর সময়কাল IBC অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন।