ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

মোবাইল প্রযুক্তির বিবর্তনের গল্প

টুটুল মাহফুজ

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ১৪ অক্টোবর ২০২২

মোবাইল প্রযুক্তির বিবর্তনের গল্প

.

বলা হয়ে থাকে, গত দশক ছিল স্মার্টফোনের রাজত্ব। ভবিষ্যতেও যে এর জয়জয়কার থাকবে, তা এক প্রকার সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়। দৈনিক যে প্রিয় জিনিসটি গড়ে আমাদের ২,৬১৭ বার স্পর্শ পায়, যার পেছনে বছরে আমাদের গড়ে ৮০০ ঘণ্টাই চলে যায়, সেই মোবাইল ফোন ও এর প্রযুক্তির ইতিকথা নিয়েই এই লেখা।
আজকের স্মার্টফোনের যে চকমকা প্রযুক্তি কিংবা এর যে আকর্ষণীয় আকার-আকৃতি, তার উন্নতি কিন্তু এক নিমিষেই হয়নি। নানা প্রতিকূলতা পেরোবার পর আজ সেটি এই রূপে এসেছে। তাই প্রাণিজগতের বিবর্তনের তুলনায় এর বিবর্তনের ইতিহাসও নেহায়েত কম আকর্ষণীয় নয় বৈকি।
মোবাইল ফোনের প্রথম সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ১৯০৮ সালে। তখন ইউএস প্যাটেন্ট সরকারী কাজে কেন্টকি রাজ্যে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের জন্য টেলিফোন-সদৃশ জিনিস স্থাপন করে। ১৯২৬ সালে জার্মানিতে রেলের ফার্স্টক্লাস যাত্রীদের সুবিধাস্বরূপ The Deutsche Reichsbahn’ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হামবুর্গ থেকে বার্লিন পর্যন্ত তাদের যাত্রীদের ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের সুযোগ করে দেয়। এই উদ্যোগই ছিল সেসময় ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন ইতিহাসের বড় এক মাইলফলক।
১৯৪৬ সালে প্রথম আমেরিকার শিকাগোতে যানবাহনে বহনযোগ্য টেলিফোন স্থাপন করা হয়। তবে সেগুলো ছিল খুবই লো ফ্রিকোয়েন্সির। খুব বেশি অপেক্ষায় থাকতে হয়নি অবশ্য, ১৯৫৬ সালে সুইডেনে এর ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়ে হাই ফ্রিকোয়েন্সির এবং রোটারি ডায়াল প্রযুক্তি যুক্ত করে যানবাহনে ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সেসময় এগুলোর ওজন ছিল মোটামুটি ৪০ কেজির কাছাকাছি। সর্বোচ্চ ১২৫টি সাবস্ক্রিপশন (কন্টাক্ট) করা যেত এতে, যা সেসময়ে অভাবনীয় এক বিষয় ছিল। তবে এগুলো ছিল অনেকটা ছন্নছাড়া উদ্যোগ, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থই এতে বেশি জড়িত থাকত।
মটোরোলা কমিউনিকেশন্স সিস্টেমসের ম্যানেজার ড. মার্টিন কুপার ১৯৭৩ সালে প্রথম হাতে বহনযোগ্য মোবাইল ফোন বাজারে নিয়ে আসেন, যার ওজন ছিল ১ কেজি ১০০ গ্রামের মতো। দেখতে অনেকটা ইটের মতো লাগায় দুষ্ট লোকেরা এর নাম ‘দ্য ব্রিকফোন’ রাখতেও ভুল করেনি। ওজনের মতো এটি অবশ্য দামেও ভারি ছিল। তৎকালে এটি কিনতে পকেট থেকে তিন হাজার ইউরো বা চার হাজার ইউএস ডলারের মতো খসাতে হতো। তাই যেমন-তেমন লোকের এ জিনিস কেনার সামর্থ্য ছিল না।
এদিকে ১৯৮২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১১টি দেশ মিলে চিন্তাভাবনা করছিল, কীভাবে এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের ধারণা পুরো ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আর বরাবরের মতোই সেই মহৎযজ্ঞের নেতৃত্বে ছিল এনএমটি।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৮৭ সালকে তখন বাহবা দিতেই হয়, কারণ এ বছরেরই একটি আবিষ্কার ওয়্যারলেস ও মোবাইল প্রযুক্তিতে রেনেসাঁর সূচনা করে দেয়। এই সময়েই জিএসএম টেকনোলজি আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে দেশীয় গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ফোনকল, ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির ব্যান্ড ও কম খরচে কাজ চালানোর সুযোগ করে দেয়। আর সেই সঙ্গে তড়তড় করে বেড়ে উঠতে থাকে মোবাইল প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। আগে যেখানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুধু কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ১৯৯২ সাল সেখানে বড় এক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেই বছরেই পৃথিবীতে প্রথম মেসেজ সার্ভিস শুরু হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে ইংল্যান্ডে যেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী সংখ্যা ১৬% ছিল, এক দশক পর সেই অঙ্ক গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ শতাংশেরও বেশি। শুধু ইংল্যান্ডে নয়, অন্যান্য উন্নত বিশ্বেও এর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল। এর পেছনে অবদান রাখে অবশ্য টেলিকম কোম্পানিগুলোর কিছু নীতি, যেমন পে-এ্যাজ-ইউ-গো, নন-কন্ট্র্যাক্ট সার্ভিসেস, ভোডাফোন প্রিপেইড প্যাকেজ প্রভৃতি।
২০০০ সাল, একবিংশ শতাব্দীর শুরুর বছরে মোবাইল প্রযুক্তি শুরু করে নতুনভাবে পথচলা। সেই পথচলায় সঙ্গী হয় নোকিয়া, বাজারে নিয়ে আসে ৩৩১০ মডেলের ‘অল ইন ওয়ান’ প্যাকেজের মোবাইল ফোন। ছিপছিপে গড়নের সেই ডিভাইসটির প্রায় ১২৬ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে শার্প কর্পোরেশন জাপানী বাজারে নিয়ে আসে প্রথম ক্যামেরাওয়ালা ফোন The sharp S-JH04| ইউরোপের অবশ্য ক্যামেরাফোন পেতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়, ২০০২ সালে নোকিয়াই তাদের ৬৭৫০ মডেলের ফোনটি ইউরোপের বাজারে ছাড়ে।
২০০৭-০৯ সাল; এই তিন বছরে মোবাইল প্রযুক্তির যে পরিমাণ অগ্রযাত্রা হয়েছে, তা বিগত ৩০ বছরকেও ছাড়িয়ে যায়। ২০০৭ সালে টেক জায়ান্ট এ্যাপল তাদের প্রথম স্মার্টফোন বাজারে ছাড়ে। ব্যতিক্রমী সব ফিচার থাকার কারণে তখন সেটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই এ্যাপল নিয়ে শুরুতে টিপ্পনিদাতারও কমতি ছিল না; ৪৯৯ ডলারের মতো চড়া দামের জন্য নোকিয়ার প্রধান নির্বাহী তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, এ্যাপল খুব বেশিদিন বাজার ধরে রাখতে পারবে না।
এর এক বছর পর এ্যান্ড্রয়েড ফোনও বাজারে চলে আসে। ধীরে ধীরে ব্ল্যাকবেরি, নোকিয়া, এরিকসনের মতো নামী-দামী টেলিকম জায়ান্টগুলোর জনপ্রিয়তা নিভু নিভু হয়ে আসছিল। আইওএস আর এ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমে তখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এ্যাপল তাদের ব্যবহারকারীদের এ্যাপ্লিকেশনের জন্য আলাদা এক প্লাটফর্ম তৈরি করে, যাকে বর্তমানে ‘এ্যাপ স্টোর’ নামে ডাকা হয়। এ্যান্ড্রয়েডও কিছুদিন পর ‘এ্যান্ড্রয়েড মার্কেট’ নামে তেমন একটি প্লাটফর্ম নিয়ে আসে। পরবর্তীতে অবশ্য নাম পরিবর্তন করে ‘প্লে স্টোর’ রাখা হয়। এতে এক বিশাল ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

 

×