
অবসরের পর আমলারা অনেকেই রাজনীতিমুখী হয়ে পড়ছেন
অবসরের পর আমলারা অনেকেই রাজনীতিমুখী হয়ে পড়ছেন। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্যের পর মন্ত্রী হওয়াই তাদের লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে অনেকেই রীতিমতো সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি লঙ্ঘনও করছেন। এমনকি চাকরিতে থাকা অবস্থায় কোনো কোনো আমলা প্রার্থী হিসেবে নিজের সম্ভাব্যতা যাচাইয়েও নেমেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এখনই দলীয় মনোনয়ন না পেলেও কেউ কেউ আবার ভবিষ্যতের আশায় রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছেন।
একটা সময় ছিল যখন আমলারা অবসরে গেলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হতেন, তাঁরা লেখালেখি করতেন এবং একটা সময়ে জাতির বিবেক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেন। ড. আকবর আলী খান, ড. শাহাদাত হোসেনরা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আব্দুল হাইয়ের মতো উপন্যাসিকরাও যে সাবেক আমলা ছিলেন তা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন।
এরপর সময় পাল্টে যায়, রাজনীতিতে আগ্রহ বাড়ে আমলাদের। আশির দশকের পর, বিশেষ করে সামরিক একনায়কদের পৃষ্ঠপোষকতায় আমলারা রাজনৈতিক মহল গরম করতে থাকেন। জিয়াউর রহমান-এরশাদের হাত ধরে বাংলাদেশে রাজনীতিতে আমলাদের অনুপ্রবেশ ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভোটের মাঠে নেমেছেন কোনো কোনো আমলা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়া আগামী নির্বাচনে নিজ এলাকা নড়াইল-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে শুরু করেছেন নির্বাচনী প্রচার। অথচ তার চাকরির মেয়াদ আছে আরও এক বছর। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার অবসর গ্রহণের পর ৩ বছর পার হওয়ার আগে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই।
যদিও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া বলেন, সরকারি চাকরিরত অবস্থায় নির্বাচনী প্রচার চালানো যায় না। এলাকার উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে প্রত্যেক সচিবকে একটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাকে নড়াইলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে আমি এলাকার সবার সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। অবসরে গেলে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করব। তখন মনোনয়নের বিষয় আসবে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় (রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।
অন্যদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর ১২ (১) (চ) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের কোনো চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন বা অবসর গমন করেছেন এবং উক্ত পদত্যাগ বা অবসর গমনের পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে। অর্থাৎ অবসর বা পদত্যাগের পর তিন বছর শেষ না হলে কোনো সরকারি চাকরিজীবী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অবশ্য এ বিধান বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে দায়িত্বরত খাজা মিয়ার সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ৪ জুলাই। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার তিন বছর পর নির্বাচন করার বিধান হাইকোর্টে বাতিল হলেই স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান খাজা মিয়া। সেই লক্ষ্যেই নির্বাচনী এলাকায় উঠান বৈঠক, পথসভা ও জনসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন তিনি, যা সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
জানা গেছে, সচিব খাজা মিয়ার বাড়ি কালিয়া উপজেলার ফুলদাহ গ্রামে। অনেকদিন ধরেই ওই এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ ঈদুল আজহার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যান তিনি। ঈদের আগে ও পরে এলাকায় কয়েকটি পথসভা ও উঠান বৈঠক করেছেন এই আমলা। এর আগেও তিনি নড়াইল সদরের একাংশ, কালিয়া ও নড়াগাতিতে সভা-সমাবেশ করেছেন। এসব সভায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, শুধু সচিব নন, কোনো সরকারি কর্মচারীজীবী এভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারেন না। যারা এ জাতীয় কর্মকা-ে যুক্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তিনি নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। আমার কাছে এমন কোনো বিষয় আসেনি। তবে সরকারি কর্মচারীদের অবশ্যই আচরণবিধি মেনে চলা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সাবেক সচিব সাজ্জাদুল হাসান সম্প্রতি নেত্রকোনা-৪ আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া চাঁদপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন সাবেক আমলা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ওই আসনে মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে এসেছেন সাবেক বাণিজ্য সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন। একই সঙ্গে ঢাকা-১০ আসনে, খুলনা-১ আসনে সাবেক আমলারা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ করছেন।