ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি চায় নয়াপল্টনেই

সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২২

সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি

২৬ শর্তে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে

২৬ শর্তে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে ডিএমপির পক্ষ থেকে বিএনপিকে অনুমতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু বিএনপি ডিএমপিতে করা এক আবেদনে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি চায়। তাই সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করার অনুমতি পেলেও বিএনপি চায় নয়াপল্টনেই করতে। এ বিষয়ে অনড় অবস্থানে দলটি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অনুমতি ছাড়া বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিএমপির উপ কমিশনার (সদর দপ্তর ও প্রশাসন) আব্দুল মোমেনের স্বাক্ষর করা এক চিঠিতে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতির কথা জানানো হয়। বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দেওয়া এক চিঠিতে সমাবেশের অনুমতির বিষয়টি জানায় ডিএমপি। মঙ্গলবার বিকেলে ডিএমপির পক্ষে পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া সমাবেশ করার অনুমতিপত্র বিএনপি কার্যালয়ে পৌঁছে দেন। রুহুল কবির রিজভী বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই অনুমতিপত্র গ্রহণ করেন।
বিএনপিকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, সমাবেশ করার বিষয়ে আপনার (রুহুল কবির রিজভী) দাখিল করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করলে যানজট ও নাগরিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে বিধায় এই স্থানের পরিবর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬টি শর্ত যথাযথভাবে পালন সাপেক্ষে ১০ ডিসেম্বর ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলো।
বিএনপিকে সমাবেশ করতে ডিএমপির দেওয়া ২৬ শর্তের মধ্যে রয়েছে ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে সমাবেশ শেষ করতে হবে, মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়া যাবে না, নেতাকর্মীরা সমাবেশ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে পারবেন এবং উদ্যানের ভেতরেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
২৬ শর্তের মধ্যে উপরোক্ত শর্ত ছাড়াও রয়েছে- স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। স্থান ব্যবহারের অনুমতিপত্রের শর্তাবলি যথাযথভাবে পালন করতে হবে। নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে।

স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশস্থলের ভেতরে ও বাইরে উন্নত রেজুল্যুশনের সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রবেশ গেটে আর্চওয়ে স্থাপন করতে হবে এবং সমাবেশস্থলে আগতদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘ভিউকল স্ক্যানার’র মাধ্যমে সমাবেশস্থলে আসা সব যানবাহন তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে।

নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশস্থলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে ও আশপাশে মাইক ব্যবহার করা যাবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে, রাস্তায় বা ফুটপাতে কোথাও লোক সমবেত হওয়া যাবে না। আজান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময় মাইক ব্যবহার করা যাবে না। ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন বা বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
২৬ শর্তের মধ্যে আরও রয়েছে সমাবেশস্থলের আশপাশসহ রাস্তায় কোনো অবস্থায় সমবেত হওয়াসহ যান ও মানুষ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে কোনো ধরনের লাঠি বা রড ব্যবহার করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি ও জননিরাপত্তা বিঘিœত হয় এমন কোনো কার্যকলাপ করা যাবে না।

রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ ও বক্তব্য দেওয়া যাবে না। উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না। নির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং করতে হবে, মূল সড়কে কোনো পার্কিং করা যাবে না। সমাবেশস্থলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করে সমাবেশ করতে হবে। উল্লেখিত শর্তাবলি পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে এবং জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া এই অনুমতি আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন।
উল্লেখ্য, ১৫ নভেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশটি নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে করার অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করে বিএনপি। আর তখন ডিএমপির পক্ষ থেকে বিএনপিকে অন্য জায়গায় সমাবেশ করতে বলা হয়। এক পর্যায়ে বিএনপিকে রাজধানী শহরের বাইরে গিয়ে সমাবেশ করতে বলা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েও বিএনপি সন্তুষ্ট নয়। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপি এখনও অনড় অবস্থানে। যে কারণে দলের নেতারা বলছেন, অনুমতি না দিলেও তারা নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবেন।
মঙ্গলবারও বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী বলেন, সমাবেশ নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশের আগে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় হামলা করা হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ যেন সফল না হয়। কিন্তু ঢাকার সমাবেশে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সাফল্যম-িত হবে। জনস্রোত নামবে ঢাকায়।

এর আগে শনিবার কুমিল্লার সমাবেশ থেকেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নয়াপল্টনেই ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির সমাবেশ পূর্বাচল থেকে যেহেতু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত আসতে পেরেছে, তাহলে নয়াপল্টনেও আসবে। তাই ১০ ডিসেম্বর পল্টনেই হবে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ।

আর সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও বলেন, বিএনপির সমাবেশ নয়াপল্টনেই অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনেই বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, সরকার অনুমতি দিক বা না দিক, নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই বিএনপি সমাবেশ করবে।
২৪ নভেম্বর সদরঘাটে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, বিএনপিকে শর্ত সাপেক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে গঠনমূলক রাজনীতি করবে। এখানে আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই।

তারা যদি রাজনৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করে কিছু করে, তখন আমাদের অবজেকশন থাকে। সেটা আমরা সব সময় বলে আসছি। তাদের আমরা কখনোই মানা করিনি, তারা সারাদেশেই মিটিং করছে, সমাবেশ করছে। ঢাকার সমাবেশকেও আমরা মানা করিনি। আমরা শুধু তাদের আশঙ্কার কথাগুলো বলেছি। আপনারা ২৫-৩০ লাখ লোক নিয়ে আসবেন, এই লোকগুলো কোথায় বসাবেন? কোথায় থাকবে তারা? পুরো ঢাকা শহর অচল করে দেবেন আপনারা।

আমরা বলেছি তাদের, বড় কোনো জায়গায় যান। বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে পারবে। কিন্তু কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো যাবে না। প্রতিবন্ধকতা ও জনদুর্ভোগ করা যাবে না। এটা তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে।
উল্লেখ্য, ১৫ ডিসেম্বর বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপি কার্যালয়ে গিয়ে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টননে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি চায়। এ বিষয়ে তারা ডিএমপি কমিশনার বরাবরে একটি চিঠিও দেন। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে নয়াপল্টনের পরিবর্তে অন্য স্থানে সমাবেশ করতে বলা হয়। কিন্তু বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় থাকে। এক পর্যায়ে দলটির নেতারা বলতে থাকেন অনুমতি না পেলেও বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে।
রাজপথে আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জুলাই মাস থেকেই ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু করে বিএনপি। আর ১২ অক্টোবর থেকে নতুন উদ্যমে ১০ বিভাগে গণসমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে। প্রথম গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে। দীর্ঘদিন পর এই গণসমাবেশে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়।

১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহের গণসমাবেশ কর্মসূচিতেও বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতি ঘটে। এরপর ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা গণসমাবেশ করে বিএনপি। ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে গণসমাবেশের পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় করা হবে মহাসমাবেশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে ইতোমধ্যেই বিএনপিকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি পাওয়ার পরও নয়াপল্টনে সমাবেশ করার বিষয়ে বিএনপি আগের অবস্থানেই আছে। দলের নেতারা জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি পাওয়ার পর এখন নতুন করে আবারও নিজেরা বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, এখন পর্যন্ত নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ হবে এটাই আমাদের দলের সিদ্ধান্ত। আর আমরা তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চাইনি।

×