
ধান ফলাই, কিন্তু লাভ পাই না’, বলছিলেন জামাল মিয়া
ধান ফলাই, কিন্তু লাভ পাই না’, বলছিলেন জামাল মিয়া, সুনামগঞ্জের এক বন্যা-ভুক্ত কৃষক। গবেষকরা আসেন না, প্রযুক্তিও আসে দেরিতে। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনিই আজ এক নীরব উদ্ভাবক। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণায় এখনো মানুষ-প্রকৃতি-প্রযুক্তির সমন্বিত বোঝাপড়ার বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের গবেষণাগারে উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়, কিন্তু সেই জাত বাস্তব জীবনের জটিলতার মুখে পড়ে মাঠে টিকে থাকে না। কৃষক বলেন, ‘জাত ভালো, কিন্তু রোগ বেশি। সার লাগে বেশি।
দাম ঠিক পাই না।’ তথ্য আছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনা নেই। আমাদের কৃষিতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, কম খরচে বেশি উৎপাদন, এবং টেকসই কৃষির দিশা খুঁজে বের করা। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জের কথা গবেষণায় কম, আর মাঠের কৃষকের ভাষায় তো একেবারেই নেই।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। উন্নতজাতের উদ্ভাবন, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কিছু ক্ষেত্রে রপ্তানিও বেড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত নতুন প্রযুক্তি ও জাত উদ্ভাবন করছে। কিন্তু এই উন্নয়নের ঝলমলে পরিসংখ্যানে ঢেকে গেছে দেশের মাটি থেকে জীবিকা অর্জনকারী কৃষকের কষ্ট ও সংগ্রাম। আমাদের কৃষকরা আজও নানা জলবায়ু ঝুঁকি ও দুর্যোগের মুখে প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ কৃষি গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের মঞ্চে কৃষকের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের কৃষির জন্য উদ্বেগজনক।
কৃষকের বাস্তব চ্যালেঞ্জ ও গবেষণার ফাঁক : গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ, বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে, জলবায়ু সংকটের কবলে। খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টি, এসব দুর্যোগের সম্মুখীন হয় আমাদের কৃষকরা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। ২০২২ সালে হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যায় ৯০% বোরো ধান ধ্বংসের মতো ঘটনা পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু কৃষি গবেষণা এখনো মূলত ‘আদর্শ পরিস্থিতি’র ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত, যা বাস্তব ঝুঁকি ও কৃষকের চ্যালেঞ্জ থেকে অনেক দূরে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৬.৫ মিলিয়ন কৃষক পরিবার আছে, যাদের অধিকাংশের জমির আকার দুই হেক্টরের কম। এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা নানা জলবায়ু পরিবর্তন, কীটপতঙ্গের আকস্মিক আক্রমণ ও আবহাওয়ার অনিয়মিততা মোকাবেলায় তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে কৃষি চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রকৃত ‘মাঠ বিজ্ঞানী’ এবং তাদের অন্তর্নিহিত জ্ঞানকে কৃষি গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আনা এখন সময়ের দাবি।
অংশগ্রহণমূলক গবেষণা : বিশ্বব্যাপী ‘অংশগ্রহণমূলক গবেষণা’ বা পার্টিসিপেটরি রিসার্চের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কৃষকের অভিজ্ঞতা, চাহিদা এবং মতামতকে গবেষণার সঙ্গে একত্রিত করা হয়, ফলে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বা জাতগুলো মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়। বাংলাদেশেও এর কিছু সফল উদাহরণ দেখা যায়। যেমন, ‘ফার্মার ফিল্ড স্কুল’ কর্মসূচিতে কৃষকরা ১২টি জেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বন্যা সহিষ্ণু ধানের জাত ইজজও ধান ৫১ ও ৫২ পরীক্ষা ও নির্বাচনে যুক্ত হয়েছেন। এর ফলাফল অত্যন্ত ইতিবাচক; বন্যাপ্রবণ এলাকায় এই জাত গ্রহণের হার ৩৮ শতাংশের বেশি, যা অন্য জাতের তুলনায় অনেক বেশি।
চর ও উপকূলীয় অঞ্চলের নারী কৃষকরাও নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ভেসে থাকা বাগান তৈরি, হারবাল পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও ক্ষুদ্র জলাশয়ে মাছ-ধানের যৌথ চাষের মতো উদ্ভাবনী কর্মকা- করছেন। এগুলো গবেষণার ল্যাবের বাইরে হলেও মাঠে প্রমাণিত ও কার্যকর। এই ‘মাঠের বিজ্ঞান’ যদি কৃষি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে তা হবে বাংলাদেশের কৃষির জন্য এক নতুন দিগন্ত।
গবেষণা ও বাস্তব মাঠের বিচ্ছিন্নতা : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (ইঅজঈ) অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৫০টিরও বেশি নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। কিন্তু গত দশকে এই উদ্ভাবনের মাত্র ১২ শতাংশই কার্যকরভাবে কৃষকের মাঠে পৌঁছেছে। বাকিগুলো গবেষণা প্রতিবেদন বা প্রদর্শনী প্লটেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর মূল কারণ হলো, গবেষণার প্রতিটি ধাপে কৃষকের অভিজ্ঞতা ও মতামত যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া। গবেষকের চোখে উদ্ভাবন সফল হলেও তা কৃষকের বাস্তব জীবনে কতটা কার্যকর এবং লাভজনক তা বিবেচনায় আনা হয় না।
তাছাড়া, কৃষি গবেষণার জন্য বরাদ্দ মোট কৃষি জিডিপির মাত্র ০.৪ শতাংশ, যা এফএও (ঋঅঙ) এর সুপারিশকৃত ১% এর অর্ধেকেরও কম। বরাদ্দের ৬০ শতাংশ চলে যায় বেতন ও অফিস খরচে; মাঠভিত্তিক গবেষণা বা কৃষক সংযুক্তির জন্য বরাদ্দ সীমিত। অর্থাৎ কাঠামোগত সমস্যাও বড় বাধা।
তথ্যের অভাব না, ব্যবস্থাপনার অভাব : আমাদের প্রায়ই তথ্যের অভাবের কথা শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কৃষি গবেষণা, আবহাওয়া পূর্বাভাস, মাটি, কীটপতঙ্গের ওপর ডেটা পাওয়া যায়। সমস্যাটি হচ্ছে, তথ্যগুলো যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক সময়ে কৃষকের কাছে পৌঁছানো হয় না। কৃষকের নির্দিষ্ট জমি বা ফসলের উপযোগী তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাও এখনো অপর্যাপ্ত। তথ্য ভাগাভাগি ও ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ৯৮ শতাংশ কভারেজ থাকলেও, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কৃষকের কাজে লাগানো এখনো সীমিত। স্মার্ট অ্যাপ, ডিজিটাল পরামর্শ ও স্থানীয় কৃষক কমিউনিটির মাধ্যমে তথ্য পৌঁছে দিলে কৃষক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তথ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত না হলে, তথ্য থাকলেও কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হবে না।
আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল কৃষি : বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তি যেমন রিমোট সেন্সিং, স্যাটেলাইট ডেটা, আইওটি-ভিত্তিক মাটি ও জল পর্যবেক্ষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আবহাওয়া পূর্বাভাস কৃষকের হাতে পৌঁছানো হচ্ছে। বাংলাদেশেও ধাপে ধাপে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নতি হয়েছে, তবে বিস্তার কম। এর ফলে প্রযুক্তি ও তথ্যের সুফল কৃষকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো দেরিতে হচ্ছে।
সঠিক পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি একত্রে ব্যবহার করে তথ্য ও প্রযুক্তিকে মাঠের কৃষকের হাতের নাগালে আনাই এখন সময়ের দাবি। সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে, ডিজিটাল কৃষি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রযুক্তি নয়, কৃষকের জ্ঞানকেই কেন্দ্রবিন্দুতে আনা : সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপকল্পে স্মার্ট কৃষির কথা বলছে। ডিজিটাল কৃষি, অ্যাপভিত্তিক পরামর্শ, ব্লকচেইন, ড্রোন, ট্রেসেবিলিটি, এমন নানা প্রযুক্তি পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু বাস্তবে কয়জন কৃষক এসব জানেন বা ব্যবহার করতে পারেন? এখনো বহু কৃষক জানেন না কবে কীভাবে বাজারে পণ্য তুলবেন, মাটিতে কী ঘাটতি আছে, কিংবা কীভাবে আবহাওয়ার তথ্য কাজে লাগাবেন।
প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগে আমাদের ভাবতে হবে, এই প্রযুক্তি কৃষকের জন্য কতটা ব্যবহারযোগ্য, কতটা সহজলভ্য, আর আদৌ তাঁদের ভাষায় কথা বলে কি না। কৃষকের জমির মাটি, জলবায়ু ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি হতে হবে প্রযুক্তির কাঠামো। নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি জানতে হবে, সে জাতটি মাঠে কেমন কাজ করছে, ক্ষতি প্রতিরোধে কতটা কার্যকর, এবং তা কি কৃষকের আয় ও টেকসই চাষে সহায়ক হচ্ছে কিনা। প্রযুক্তি নয়, কৃষকের জ্ঞান ও প্রেক্ষাপটকেই রাখতে হবে আমাদের কৌশলের কেন্দ্রে।
কৃষকের হাতেই আমাদের ভবিষ্যত : বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার প্রকৃত সফলতা নির্ভর করবে কৃষকের মর্যাদা, অংশগ্রহণ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ওপর। কারণ, মাঠের কৃষকই আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের আসল স্থপতি। শুধু ল্যাবেই নয়, গবেষণাকে নিতে হবে মানুষের কাছে, মাঠের বাস্তবতায়। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কৃষকের ভাষায়, কৃষকের প্রয়োজনে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে বিজ্ঞান আর মানুষের মাঝে কোনো দূরত্ব না থাকে।
আমাদের চিন্তার কেন্দ্রে রাখতে হবে কৃষককে, যিনি নিজের ঘাম ঝরিয়ে জাতি গড়েন, খাদ্য জোগান। গবেষণার লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন প্রযুক্তি ও জ্ঞান তৈরি করা, যা কৃষকের জীবন সহজ করবে, তার আয় বাড়াবে। বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সেই কৃষকের ওপর, যিনি প্রতিদিন প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে টিকে থাকেন, যিনি অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব টেকসই ব্যবস্থা, কিন্তু যিনি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অদৃশ্য। গবেষণার সাফল্য তখনই, যখন তা পৌঁছাবে জামাল মিয়ার মতো কৃষকের হাতে। বাংলাদেশের কৃষি তখনই স্মার্ট হবে, যখন গবেষণা হবে কৃষকের ভাষায়, কৃষকের জন্য। ল্যাব নয়, মাঠই হোক আমাদের ভবিষ্যতের পরীক্ষাগার।
লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন
প্যানেল হু