ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

চীনের ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে প্রকল্প, মাওয়ের স্বপ্নের আধুনিক বাস্তবায়নে সম্ভাবনা ও সংশয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৩:৪৬, ২৯ জুলাই ২০২৫

চীনের ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে প্রকল্প, মাওয়ের স্বপ্নের আধুনিক বাস্তবায়নে সম্ভাবনা ও সংশয়

১৯৭৩ সালে চীনের তৎকালীন চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং নেপাল সফরকালে প্রথমবারের মতো একটি অভাবনীয় ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন—চীন ও নেপালকে সংযুক্তকারী একটি রেলপথ। আধা শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই রেললাইন আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও নেপাল আবারও সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী "ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে" প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অধীনে বিবেচিত হচ্ছে।

সীমান্ত বাণিজ্যে বাধা

বর্তমানে নেপাল ও চীনের মধ্যে একমাত্র কার্যকর আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ রাসুয়াগাড়ি ক্রসিং। ২০১৫ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সীমান্ত পথ এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব এ বাণিজ্য পথকে আরও দুর্বল করে তোলে। ফলে সীমিত মালবাহী লরি ও নাজুক রাস্তা পেরিয়ে বাণিজ্য চালানো এখন চ্যালেঞ্জিং।

প্রকল্পের চিত্র ও ব্যয়

নেপালের অংশে এই রেললাইন হবে মাত্র ৭২.৫ কিলোমিটার, যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশটির বার্ষিক সরকারি ব্যয়ের সমান। চীন ইতিমধ্যেই তিব্বতের শিগাটসে পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ সম্পন্ন করেছে এবং সেখান থেকে কাঠমান্ডু হয়ে ভারতের লুম্বিনী পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি হবে হিমালয়ের ওপর দিয়ে নির্মিত বিশ্বের অন্যতম জটিল রেল প্রকল্প।

প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ও ভূপ্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা

প্রকল্পের ৯৮% এর বেশি অংশ সুড়ঙ্গ ও সেতুর মাধ্যমে নির্মিত হবে। তিব্বতের ৪,৫০০ মিটার উচ্চতা থেকে নেমে নেপালের ১,২০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছানো প্রকৌশলগতভাবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। চীনা প্রকৌশলীরা তিব্বতে এর থেকেও উচ্চতায় রেললাইন নির্মাণ করলেও, ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল, ভূমিধস, প্রবল বর্ষা এবং জলের প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকল্পটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

এই রেলপথ নির্মিত হলে চীন-নেপাল বাণিজ্য অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। নেপাল কৃষিপণ্য, কাঁচামাল ও সস্তা চীনা পণ্য সহজে আমদানি করতে পারবে। পর্যটন খাতও লাভবান হবে। একইসঙ্গে যদি ভারত পর্যন্ত সম্প্রসারণ ঘটে, তবে এটি গোটা অঞ্চলের জন্য হবে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংশয়

চীন এই প্রকল্পকে কেবল অবকাঠামো নয়, বরং ভূরাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ধারণা অনেক বিশ্লেষকের। ভারত BRI-তে স্বাক্ষর না করলেও নেপালের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চীনের ভারত সীমান্ত পর্যন্ত রেল সম্প্রসারণের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এতে চীন-ভারত উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।

পরিবেশগত উদ্বেগ

বিশেষজ্ঞদের মতে, হিমালয় অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে ভঙ্গুর। WWF-এর তথ্যানুযায়ী, এই অঞ্চলে ১৬৩টি বিপন্ন প্রজাতি রয়েছে। বিস্ফোরণ, ড্রিলিং ও নির্মাণকাজ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

নেপালের সক্ষমতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি

নেপালের নিজস্ব রেল অবকাঠামো এখনও প্রাথমিক স্তরে। রেল প্রকৌশলী, চালক ও পরিচালন ব্যবস্থার অভাব প্রকল্পের টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অনেক সময় রেল মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত নয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে প্রকল্প একদিকে যেমন হতে পারে এশিয়ার অন্যতম প্রযুক্তিগত কীর্তি, তেমনি এটি হয়ে উঠতে পারে নেপালের জন্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের উৎস। ২০২৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হলে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তবে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির ভারসাম্য না রাখলে এই প্রকল্প নেপালের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণও হতে পারে।

 
 

রিফাত

×