
ছবি: সংগৃহীত
চিন্তা দিয়ে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ, এ যেন বিজ্ঞানের গল্প, কিন্তু এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিল এলন মাস্কের মস্তিষ্ক-চিপ সংস্থা নিউরালিঙ্ক। সম্প্রতি ৩৫ বছর বয়সী অড্রি ক্রুজ, যিনি ১৬ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনার পর থেকে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত (দেহের চারটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকার্যকর, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে চতুর্গামী পক্ষাঘাত বা কোয়াড্রিপ্লেজিয়া বলা হয়), তিনি শুধুমাত্র মনের শক্তি ব্যবহার করে ২০ বছর পর প্রথমবার নিজের নাম লিখেছেন।
অড্রি এই কীর্তির কথা জানিয়েছেন ‘এক্স’-এ। তিনি লিখেছেন, “আমি ২০ বছর পর নিজের নাম লেখার চেষ্টা করলাম। এখনো শিখছি, হাহা।” পোস্টের সঙ্গে ছিল একটি ডিজিটাল সাদা বোর্ডে (ডিজিটাল হোয়াইটবোর্ড) লেখা তার নাম—"Audrey", যা তিনি লিখেছেন মস্তিষ্কের সাহায্যে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে।
এ বিষয়ে এলন মাস্ক নিজেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন, “সে শুধু চিন্তা করেই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করছে। বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে এটি সম্ভব।”
২০১৬ সালে এলন মাস্ক প্রতিষ্ঠা করেন নিউরালিঙ্ক। যার লক্ষ্য হলো মস্তিষ্ক-কম্পিউটার সংযোগ প্রযুক্তি (Brain-Computer Interface বা সংক্ষেপে BCI) উন্নয়ন করা। এটি এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে মুদ্রার আকৃতির এক ধরনের চিপ মানুষের মস্তিষ্কে স্থাপন করা হয়। এই চিপের সঙ্গে যুক্ত থাকে ১২৮টি অতি সূক্ষ্ম ইলেকট্রোড-তারের মতো সুতার টুকরো, যেগুলো মস্তিষ্কের ‘মোটর কর্টেক্স’ (চলাচলের সংকেত নিয়ন্ত্রণকারী অংশ)-এ স্থাপন করা হয়।
এই চিপ মানুষের চিন্তাকে সংকেত হিসেবে গ্রহণ করে এবং তা ডিজিটাল নির্দেশনায় রূপান্তর করে। ফলে ব্যবহারকারী শুধুমাত্র মনের জোরে কম্পিউটারের কার্সর, কীবোর্ড, এমনকি বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
অড্রি জানান, তিনি সম্প্রতি মায়ামির ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সেন্টারে অপারেশনের মাধ্যমে নিউরালিঙ্ক চিপ বসিয়েছেন। তার ভাষায়, “আমার মাথার খুলিতে একটি গর্ত করে মোটর কর্টেক্স অংশে ১২৮টি সূক্ষ্ম তার বসানো হয়েছে। চিপটির আকার একটি পয়সার মতো। চিকিৎসক এবং নার্সরা আমাকে খুবই যত্নে দেখেছেন, আমি নিজেকে ভিআইপি মনে করেছি।”
তিনি আরও জানান, এই প্রযুক্তি তার চলাফেরার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে না। এটি মূলত "টেলিপ্যাথি" বা চিন্তার মাধ্যমে যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি। ভবিষ্যতে তিনি শুধু কম্পিউটার নয়, আরও অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইস মস্তিষ্কের মাধ্যমে পরিচালনা করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
একজন অনুসারীর প্রশ্নে অড্রি জানান, তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন। “আমি ১৬ বছর বয়স থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আমার জীবনে বলার মতো অনেক ঘটনা আছে,” বলেন তিনি।
গত বছর নিউরালিঙ্ক মানবদেহে প্রথম চিপ স্থাপনের জন্য নিয়ন্ত্রক অনুমতি পায়। এরপর একটি সার্জিক্যাল রোবটের মাধ্যমে চিপটি মস্তিষ্কের সেই অংশে বসানো হয়, যা চলাচলের ইচ্ছা তৈরি করে। এখন সেই চিপ ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই কীবোর্ড, মাউস, কার্সর পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছেন।
নিউরালিঙ্ক বর্তমানে একটি ‘স্মার্ট বায়োনিক চোখ’ (কৃত্রিম দৃষ্টি প্রযুক্তি) তৈরি করতে ক্যালিফোর্নিয়া ও স্পেনের গবেষকদের সঙ্গে গবেষণা চালাচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা মানুষের মুখ চিনতে, রাস্তা চিনে চলতে এবং বই পড়তেও সক্ষম হবেন।
তারা আরও একটি ‘Blindsight’ নামের চিপ তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। এই চিপটি ইতিমধ্যে বানরের ওপর সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষের ওপর প্রয়োগের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে।
এলন মাস্ক নিউরালিঙ্ককে ভবিষ্যতের সীমানা ভাঙা প্রযুক্তি হিসেবে দেখছেন। তার দাবি, ভবিষ্যতে এই চিপ স্থূলতা, বিষণ্ণতা, অটিজম এবং স্কিজোফ্রেনিয়া (এক ধরনের মানসিক বিকার)-এর মতো অসুস্থতা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে।
ব্লুমবার্গ -এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩১ সালের মধ্যে নিউরালিঙ্কের বাৎসরিক আয় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মুমু ২