
ছবি: প্রতীকী
বর্তমানে প্রযুক্তির এই যুগে শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার বিষয়টি অনেক বাবা-মার কাছেই দোটানায় ফেলে দেয়। একদিকে নিরাপত্তা, যোগাযোগ এবং শিক্ষার প্রয়োজনে ফোনের দরকার পড়ে, আবার অন্যদিকে ইন্টারনেট, গেম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন বিপদের ঝুঁকিও থেকে যায়। তাই সন্তানকে ফোন দেওয়ার আগে ও দেওয়ার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেটিং চেক করা খুবই জরুরি। এতে আপনি যেমন সন্তানের ফোন ব্যবহারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন, তেমনি তাদের মনোযোগও সঠিক পথে থাকবে।
প্রথমেই যে বিষয়টি চেক করতে হবে তা হলো প্যারেন্টাল কন্ট্রোল। প্রতিটি স্মার্টফোনেই এখন প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সুবিধা রয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনে “Family Link” অ্যাপ ব্যবহার করে আপনি সন্তানের ফোনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। যেমন, কোন অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারবে, দিনে কতক্ষণ ফোন ব্যবহার করতে পারবে, কোন কোন অ্যাপ কত সময় ব্যবহার করা যাবে এসব আপনি ঠিক করে দিতে পারবেন। আবার অ্যাপল ডিভাইসে “Screen Time” সেটিংয়ের মাধ্যমে একই রকম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি একদম প্রথম ধাপ হিসেবে জরুরি, কারণ এটি ছাড়া অন্য সব নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় কাজ নাও করতে পারে।
এরপর দেখতে হবে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও ইউটিউব ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আছে কি না। সন্তানের ফোনে ব্রাউজারে ‘সেফ সার্চ’ অপশনটি চালু করে রাখতে হবে, যাতে করে অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্টগুলো ফিল্টার হয়ে যায়। ইউটিউব ব্যবহারের ক্ষেত্রে "YouTube Kids" ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। সাধারণ ইউটিউবে অনেক সময় বাচ্চাদের জন্য অনুপযুক্ত ভিডিও চলে আসে। তাই "YouTube Kids" অ্যাপের মাধ্যমে শুধু বয়স অনুযায়ী কনটেন্টই তারা দেখতে পারবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অ্যাপ ডাউনলোড এবং ইনস্টলেশনের সীমা নির্ধারণ। সন্তান যেন কোন অ্যাপ ইচ্ছেমতো ডাউনলোড বা ইনস্টল না করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরে গিয়ে পাসওয়ার্ড বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া কোনো অ্যাপ ইনস্টল না হয় এমনভাবে সেট করে দিতে হবে। এতে তারা আপনার অনুমতি ছাড়া কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারবে না।
লোকেশন ট্র্যাকিং ফিচারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কোথায় আছে— এসব জানা জরুরি হয়ে পড়ে। এজন্য “Find My Device” বা “Find My iPhone” ফিচার চালু রাখা উচিত। এছাড়া গুগলের Family Link-এ লোকেশন ট্র্যাক করার সুবিধাও রয়েছে। তবে এটি সন্তানকে আগেই জানিয়ে ব্যবহার করাই ভালো, যাতে তারা আপনার ওপরে বিশ্বাস রাখতে পারে।
নোটিফিকেশন কন্ট্রোল বা বারবার আসা বিজ্ঞাপন এবং মেসেজ নিয়ন্ত্রণ করাও দরকার। অনেক সময় অ্যাপ ইনস্টল করলে নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপন বা বার্তা আসে যা সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে পারে। ফোনের সেটিংসে গিয়ে আপনি কোন অ্যাপ থেকে কোন ধরনের নোটিফিকেশন আসবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বিশেষ করে গেম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপগুলো থেকে আসা অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা ভালো।
ডাটা ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করাও দরকার। অনেক সময় ইন্টারনেট থাকলে শিশু ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও দেখে বা গেম খেলে সময় নষ্ট করে ফেলে। এজন্য ফোনের “Data Limit” অপশন ব্যবহার করে দৈনিক বা মাসিক ইন্টারনেট ব্যবহার সীমিত করে দেওয়া উচিত। এতে ফোনে ইন্টারনেট থাকবে, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারের ঝুঁকি কমবে।
এছাড়া, নাইট মোড বা ব্লু লাইট ফিল্টার চালু রাখা ভালো, বিশেষ করে রাতে ব্যবহার করলে চোখের উপর প্রভাব কম পড়ে। ফোনে যদি “Digital Wellbeing” ফিচার থাকে, তাহলে দেখে নিতে হবে সন্তান দিনে কতক্ষণ ফোন ব্যবহার করছে, কোন অ্যাপ বেশি ব্যবহার করছে— এসবও জানা যাবে।
সবশেষে, সন্তানকে ফোন দেওয়ার আগে বা পরে শুধু প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়। তাকে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। ফোন ব্যবহারের নিয়ম, সময় এবং দায়িত্বগুলো ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে। আপনি যে তার উপকারের জন্য এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেটা জানিয়ে দিলে সে বিরক্ত না হয়ে বরং সহযোগিতা করবে। মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি কখনো ভালো আবার কখনো ক্ষতির কারণও হতে পারে— এটি বুঝিয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
এইসব সেটিংস ঠিকভাবে চেক করে এবং ব্যবহার করে আপনি আপনার সন্তানকে নিরাপদ ও সচেতন মোবাইল ব্যবহারকারী করে তুলতে পারবেন। সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে শিশুরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে পারবে, এবং একই সাথে অনলাইন ঝুঁকি থেকেও রক্ষা পাবে।
এম.কে.