ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

রিয়াদের অট্টালিকা, আমাদের রাজনীতি এবং মারিও পুজোর ‘গডফাদার’

এস এম নাহিদ হাসান,ফরিদপুর, পাবনা

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:০৯, ২৯ জুলাই ২০২৫

রিয়াদের অট্টালিকা, আমাদের রাজনীতি এবং মারিও পুজোর ‘গডফাদার’

'সমন্বয়ক' শব্দটি আজ থেকে বছরখানেক আগে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ করেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয় ঢালাওভাবে বলা যায় কিনা জানি না, তবে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয় শব্দটি একটি ইতিবাচক ধারণা দেয়। তবে সুনির্দিষ্টভাবে অনুমেয়, এই মুহূর্তে সমন্বয়ক শব্দটি ইতিবাচক ধারণার পাশাপাশি প্রবল নেতিবাচক ধারণাও দেশবাসী এমনকি বিশ্ববাসীকে দিচ্ছে।

কয় বছর বয়স হবে 'রিয়াদ' ছেলেটার? বড়জোর ২২/২৩। এ বয়সী একটি ছেলের দুচোখ ভরে থাকে স্বপ্ন। বুকে থাকে বাঁধভাঙার সাহস, আর সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়। হাজারো রঙিন স্বপ্ন বোনে এই বয়সের চিত্ত। দিনরাত চেষ্টা থাকে স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করার। বাবা-মার দরিদ্রতা দূর করার স্বপ্ন দেখাটা এই বয়সে অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং প্রশংসনীয়। কুঁড়েঘর সরিয়ে ফেলে সেখানে অট্টালিকা নির্মাণ করার স্বপ্ন তো এই বয়সী ছেলেরাই দেখবে। তাহলে 'সমন্বয়ক' রিয়াদ একটি অট্টালিকা নির্মাণ করে কি ভুল করেছে? এত আলোচনা-সমালোচনার কী আছে?

আলোচনা-সমালোচনার কারণটি হল, এই বয়সে একটি ছেলের যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করার কথা, রিয়াদ ঠিক তার উল্টো পথে গিয়ে অসদুপায় অবলম্বন করেছে; রাষ্ট্রবিরুদ্ধ, নীতিবিরুদ্ধ এবং আইনবিরুদ্ধ কাজ করেছে।

আলোচনা তো শুরু হয়েছে, রিয়াদ যখন একটি অপরাধ করে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে। যতদিন পর্যন্ত অপরাধ করে হাতেনাতে ধরা পড়েনি, ততদিন পর্যন্ত তার সম্মানহানি হয়নি। সেই অপরাধের খোঁজও কেউ নেয়নি। ‌রিয়াদ যে অপরাধ করছিল, এটা কি কেউ দেখছিল না? এই বয়সী একটি ছেলে শুধুমাত্র একটি নাম, একটি শব্দ 'সমন্বয়ক' ব্যবহার করে লক্ষ বা কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছে সেটি কি সবার অলক্ষ্যে? তা তো হওয়ার কথা না। বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদাবাজি বা সমজাতীয় অপরাধ তো সে এক জায়গায় করেনি। সব জায়গাতেই কোন না কোন প্রমাণ সে ছেড়ে এসেছে, সাক্ষী রেখেছে। তাহলে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলল না কেন? লোভের কারণে, ভয়ের কারণে, নাকি 'গডফাদার' হওয়ার স্বপ্নের কারণে?

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারবিরোধী যে বিপ্লবগুলো সংগঠিত হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যম্ভাবী। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
১৯৭৩ সালের গ্রিসের এথেন্স পলিটেকনিক বিদ্রোহ, একই সালের থাইল্যান্ডের অক্টোবর বিপ্লব, ১৯৭৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো বিদ্রোহ, ১৯৮৯ সালের চেকোস্লোভাকিয়ার ভেলভেট রেভলিউশন ছাত্রদের সম্পৃক্ততায় সরকারকে প্রভাবিত করার বা পতনের দিকে ঠেলে দেওয়ার অসাধারণ উদাহরণ। এছাড়া ২০১০ সাল থেকে 'আরব বসন্ত' নামক আন্দোলনে তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও বাহরাইনে ছাত্রদের ভূমিকা বিশ্ববাসী দেখেছে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা যে ভূমিকা রেখেছিল, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

উল্লেখ্য, এই সকল আন্দোলনে ছাত্ররা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বলপ্রয়োগ বা অন্য কোন কায়দায় তাদের দাবি মানতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল। পরবর্তীতে অভিজ্ঞ, অপেক্ষাকৃত সৎ ও দক্ষ রাজনীতিবিদ বা ব্যক্তি বিশেষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে তারা তাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই তারা প্রচলিত বিধি-বিধান, এমনকি সংবিধান পরিমার্জন, সংশোধন বা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।

২০২৪ সালে যে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে হয়েছিল, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল আমাদের ছাত্ররা। ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের আন্দোলন অত্যন্ত স্বাভাবিক, প্রশংসনীয় এবং দেশ, সময় ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত যৌক্তিক বটে। তবে ২০২৪-এর আন্দোলন পরবর্তী ছাত্রদের ভূমিকা সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে নেই। ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরাচারী বা অপছন্দনীয় সরকারবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র সমাজ সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে—এমন নজির আছে, তবে ছাত্রদের পক্ষ থেকে দল গঠন করে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করার বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নজির মোটাদাগে নেই!

নজির না থাক, নজির না থাকলেই কখনো কোনো ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটতে পারে না—এমন নয়। মঙ্গল হয়—এমন ঘটনা, এমন কাজ সবসময় গ্রহণযোগ্য। তবে এখানে কিছু ব্যাপার থেকেই যায়। বিরল কোনো ঘটনা যখন প্রথমবারের জন্য প্রচলিত প্রথা ভেঙে প্রতিষ্ঠিত করার আয়োজন চলে, তখন তা হতে হয় সর্বজন স্বীকৃত, সর্বজন গ্রহণযোগ্য, সর্বজন প্রশংসিত এবং সর্বজনীন অংশগ্রহণে। সেই প্রক্রিয়াটিকে হতে হয় স্বচ্ছ এবং সততায় আচ্ছাদিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি এমন কিছু হচ্ছে?

ছাত্র সমন্বয়ক রিয়াদ যে বাড়িতে চাঁদা চাইতে গিয়ে ধরা পড়েছে, সেটি পতিত সরকারের এক সাবেক এমপির বাড়ি। শোনা যায়, রিয়াদ নাকি খুব বেছে বেছে পতিত সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের টার্গেট করে চাঁদাবাজি করতো। এই সুযোগ সে পেয়েছে, কারণ ওই মন্ত্রী-এমপি বা নেতাদের ২৪ পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারের সাথে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা ছিল। সেই সংশ্লিষ্টতা যদি কোনো এমপি বা মন্ত্রী বা উল্লেখযোগ্য কোনো নেতার ক্ষেত্রে 'ফ্যাসিস্টের সহযোগী' বা 'ফ্যাসিস্টের দোসর' নামের তকমা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হয় এবং তাকে প্রযোজ্য বা অপ্রযোজ্য যেকোনো শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে তা কি অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?

এই রিয়াদ নামের ছাত্র সমন্বয়কটি সহ কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের অনেকেই ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে কোনো না কোনোভাবে সেই সরকারের দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত এবং অনেকেই সেই পতিত সরকারের ছাত্র সংগঠনের পদস্থ নেতা ছিল। তাহলে ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগী হিসেবে তার সুবিধা ভোগ করা যদি অপরাধ হয়, সেটি কি শুধু সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আর কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?

এখানে অপ্রত্যাশিতভাবে, খেয়াল খুশিমতো, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি মারাত্মক দ্বৈত নীতি কাজ করছে। পছন্দের একটি শ্রেণীকে ‌সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, অপরাধ ক্ষমা করা হচ্ছে এবং অপর শ্রেণীকে সেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। এতে যৌক্তিকভাবেই প্রেক্ষাপট তৈরির মাধ্যমে একটি 'গডফাদার' শ্রেণী তৈরি হচ্ছে, যারা সুকৌশলে তাদের লোমশ কালো থাবা বিছিয়ে, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে, প্রভাব বিস্তার করে ও প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যমে সমাজে ধনী, ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী হিসেবে তৈরি হয়ে উঠছে বা উঠতে চাইছে, কখনো কখনো নিজেদের নেতিবাচক চরিত্রকে আড়াল করে!

অপরাধ ঢাকতে হলে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিকল্প থাকে না। সমন্বয়ক রিয়াদ গংদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্রয়টা দিয়েছে কারা—এই প্রশ্নটি যাদের করা উচিত, তারা না করলেও জনসাধারণ কিন্তু এই প্রশ্নটি নিয়ে চর্চা করছে, উত্তরও বোধহয় পেয়ে গেছে! মারিও পুজো যাই লিখুক, ভালোকে মন্দ বা মন্দকে ভালো বলা ভীষণ ঝুঁকির, আর তা অনুধাবন করার সময় বোধ হয় এসে গেছে!

 

 

লেখক:

এস এম নাহিদ হাসান
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
ফরিদপুর, পাবনা

আফরোজা

×