
ছবি: সংগৃহীত
আমাদের হৃদপিণ্ড শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি, যা নিরন্তর রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে জীবন ধারণ নিশ্চিত করে। অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এমন একটি অভ্যাস আছে, যা অজান্তেই এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এই অভ্যাসটি এতটাই সাধারণ যে, প্রায় ৯০% মানুষই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন নন। আর এই অভ্যাসটি হলো: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা।
আজকের ডিজিটাল যুগে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা একটি সাধারণ ঘটনা। অফিস, স্কুল, বাড়িতে টেলিভিশন দেখা বা মোবাইল ফোন ব্যবহার—আমাদের জীবনের একটি বড় অংশ এখন বসে বসেই কাটে। কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ অভ্যাসটিই আপনার হার্টের জন্য একটি 'নীরব ঘাতক' হয়ে উঠতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা কেন হার্টের জন্য এত বিপজ্জনক?
১. রক্ত সঞ্চালনের ওপর প্রভাব: যখন আপনি দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন, তখন শরীরের রক্ত সঞ্চালন ধীর হয়ে যায়। এর ফলে রক্তনালীতে চর্বি জমার (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস) ঝুঁকি বাড়ে, যা হৃদরোগের প্রধান কারণ।
২. মেটাবলিজম ধীর করে: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে শরীরের মেটাবলিজম বা বিপাক প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর হয়ে যায়। এর ফলে শরীর ক্যালরি কম পোড়ায় এবং চর্বি জমাতে শুরু করে, বিশেষ করে পেটের চারপাশে। পেটের মেদ হৃদরোগের একটি বড় ঝুঁকি।
৩. ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়: শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, অর্থাৎ শরীর ইনসুলিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে, যা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
৪. উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি: গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বেশি হয়। উচ্চ রক্তচাপ হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
৫. খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) কমিয়ে দেয়, যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৬. পেশী দুর্বলতা: বসে থাকার ফলে শরীরের প্রধান পেশীগুলো (বিশেষ করে পায়ের পেশী) নিষ্ক্রিয় থাকে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। পেশীগুলো ক্যালরি পোড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেশী দুর্বল হলে মেটাবলিজম আরও ধীর হয়।
আপনার হার্টকে সুরক্ষিত রাখতে কী করবেন?
এই নীরব ঘাতক অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে খুব বেশি কঠিন কিছু করার প্রয়োজন নেই, শুধু কিছু ছোট পরিবর্তন আপনার জীবনকে বাঁচাতে পারে:
প্রতি ৩০ মিনিট পর বিরতি: যদি আপনার বসে কাজ করার অভ্যাস থাকে, তাহলে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর উঠে দাঁড়ান এবং ২-৫ মিনিটের জন্য হালকা হাঁটাচলা করুন।
সিঁড়ি ব্যবহার করুন: লিফট বা এসকেলেটরের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
হাঁটাচলার সুযোগ তৈরি করুন: ফোন কলের সময় হেঁটে কথা বলুন, অফিসে সহকর্মীর কাছে হেঁটে যান, বা দুপুরের খাবারে বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আসুন।
স্ট্যান্ডিং ডেস্ক ব্যবহার: যদি সম্ভব হয়, তাহলে মাঝে মাঝে স্ট্যান্ডিং ডেস্ক ব্যবহার করুন, যাতে বসে থাকার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজও করতে পারেন।
নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম (যেমন দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাইক্লিং) করুন। এটি আপনার কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে।
হালকা প্রসারিত ব্যায়াম: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর শরীরের পেশীগুলোতে টান পড়ে। হালকা প্রসারিত ব্যায়াম (stretching) করলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং পেশী শিথিল হয়।
মনে রাখবেন, সুস্থ থাকতে হলে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রণ বা ব্যায়ামই যথেষ্ট নয়; আপনার দৈনন্দিন চলাফেরার অভ্যাসও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে আজই দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার অভ্যাস ত্যাগ করুন এবং আরও সক্রিয় জীবনযাপন শুরু করুন। আপনার হার্টকে ভালোবাসুন, কারণ এটি আপনার জীবনের ইঞ্জিন।
ফারুক