ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

ঢাকা হারিয়েছে ৬০ শতাংশ জলাধার, নগরায়নের জোয়ার বেড়েছে ৭ গুণ: গবেষণা

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৯ জুলাই ২০২৫

ঢাকা হারিয়েছে ৬০ শতাংশ জলাধার, নগরায়নের জোয়ার বেড়েছে ৭ গুণ: গবেষণা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশের বেশি জলাধার গত ৪৪ বছরে হারিয়ে গেছে। একই সময়ে বেড়েছে নির্মাণাধীন ভবন, সড়ক ও কংক্রিটের বিস্তার—যার পরিমাণ প্রায় সাত গুণ। একাধিক স্যাটেলাইট চিত্র, গরমের মানচিত্র ও স্থানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

‘ঢাকা উইদাউট ন্যাচার? রিথিংকিং ন্যাচারাল রাইটস লেড আরবান সাসটেইনেবিলিটি’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি সোমবার (২৮ জুলাই) প্রকাশ করে দ্য চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। এতে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩–৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বসবাসের জন্য সহনীয় পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

ছবি: সংগৃহীত

গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় গাছপালা বা সবুজ এলাকার পরিমাণ কমে ২১.৬ শতাংশ থেকে ১১.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতি ব্যক্তি মাত্র ৩.৪৪ বর্গমিটার সবুজের সুবিধা পাচ্ছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ৯ বর্গমিটার হওয়া উচিত। ঢাকা দক্ষিণে (২.৩৩ বর্গমিটার) অবস্থা আরও করুণ। আদাবর, রামপুরা, কাফরুল, বংশাল ও ওয়ারি এলাকায় কার্যত গাছ বলতে কিছুই নেই।

জলাধারের অবস্থা আরও সংকটজনক। ঢাকার মোট জমির মাত্র ৪.৮ শতাংশ এখন জলাধার হিসেবে টিকে আছে। প্রতি ব্যক্তি মাত্র ১.৪৩ বর্গমিটার জলাধারের অংশীদার, যেখানে সুপারিশকৃত মান ৪.৫ বর্গমিটার। সুত্রাপুর, মিরপুর, গেন্ডারিয়া ও কাফরুল এলাকায় পানির অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।

গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৮০ সালে যেখানে ঢাকা শহরের ৬.৮ শতাংশ ছিল জনবসতিপূর্ণ (built-up) এলাকা, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৮.৯ শতাংশ।

‘হিট আইল্যান্ড’ হয়ে উঠছে ঢাকা

গবেষক ও দ্য চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ২ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছাবে, অথচ গাছ ও জলাশয়ের পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমে গেছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা একেবারে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে।’

তাঁর নেতৃত্বে করা গবেষণাটি বলছে, ঢাকার মাটি ও স্থলের তাপমাত্রা বেড়ে এখন ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে কোনো অঞ্চল নেই। হজরতপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা ও দারুস সালাম এলাকায় তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রির ওপরে চলে গেছে, যা শহরকে ‘হিট আইল্যান্ড’-এ রূপান্তর করছে।

ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টিতে গঠিত এলাকার ঘনত্ব ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে আদাবর, মিরপুর, রামপুরা, উত্তরার পশ্চিমাংশ, কাফরুল, বংশাল, সুত্রাপুর, ওয়ারি, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, শ্যামপুর, কোতয়ালি, চকবাজার, পল্টন ও হাজারীবাগের মতো এলাকা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত গঠিত হয়ে পড়েছে। ফলে ঢাকায় পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য কোনো ‘বাফার’ অবশিষ্ট থাকছে না।

গবেষণায় ঢাকার জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে এনআরএলজি (নেচার রাইটস-লেড গভর্নেন্স) ভিত্তিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—প্রকৃতির অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া, জলাভূমি ও বন ধ্বংসকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ডিটেইল এরিয়া প্লান (ড্যাপ) সংস্কার করে পরিবেশভিত্তিক জোনিং, স্থানীয় জনগণের সম্পদ রক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নিম্ন আয়ের এলাকায় সবুজ বিনিয়োগ এবং ৫৬.৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় গাছ রোপণ করা।

ছবি: সংগৃহীত

নতুন এই গবেষণাটি প্রসঙ্গে এম জাকির হোসেন বলেন, ‘যদি অপরিকল্পিত নগরায়ন চলতেই থাকে, তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকা শহর মানুষ ফেলে চলে যেতে বাধ্য হবে। এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনই বাকি থাকা সবুজ ও উন্মুক্ত এলাকাগুলোর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিকল্পনায় যেতে হবে।’

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ঢাকার সম্ভাব্য পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতে তাৎক্ষণিক ও ফলপ্রসূ সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।

রাকিব

আরো পড়ুন  

×