
রাজধানীসহ দেশের সুবিধা বঞ্চিত সকল শিশু-কিশোর সহ মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসনে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণের অত্যাবশ্যকীয় সময় এখনই। সমাজের নানা বিষয়ে আমরা নিজেদেরকে পরিপূর্ণ সচেতন মনে করলেও উদ্বুদ্ধ সমস্যায় জর্জরিত এই বিষয়টিকে নিয়ে হয়ত একটু ভাবার সময় আমাদের নেই!
শিশু শব্দটির সাথে জড়িত আছে মায়ের মমতা, বাবার আদর্শ ও পরিবারের ভালবাসা। শিশুদের নিয়ে একটি স্নেহের ও মায়াভরা পরিবেশ সৃষ্টি হয় নিজের অজান্তে ও মনের গহীনে। ধনী হউক, দরিদ্র হউক, ফর্সা হউক, কাল হউক সব শিশুই যে পবিত্র এই কথাটি সত্য। একটা বয়স পর্যন্ত প্রতিটি শিশু সবার কাছে পবিত্র ও আদরের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। এই শিশুদের একটি বিশাল অংশ যাদের পথশিশু হিসেবে অভিহিত করা হয় তারা পারিবারিক বন্ধন থেকে বঞ্চিত হয়েই ঠিকানা বিহীন জীবন অতিবাহিত করে থাকে। মা-বাবার যেমন সঠিক পরিচয় মেলেনা তেমনি স্থায়ী কোন নির্দিষ্ট ঠিকানাও তাদের নেই। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেই দিন দিন পথশিশুদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই পথশিশুরা জীবিকার প্রয়োজনে এবং তদারকির অভাবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে কর্মকাণ্ডের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সুশিক্ষা ও সুনামের অভাবে এক সময় এই কচি কচি পথ শিশুরা মাদকপাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে ব্যক্তিগত জীবনে সেও মাদকাসক্তে পরিণত হয়। ফলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুনর্বাসনে জরুরি উদ্যোগ আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ঢাকা আহছানিয়া মিশন আয়োজিত এক সেমিনারে পথশিশুদের অনেক সমস্যার মধ্যে মাদক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এক সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখই মাদকাসক্ত। যে শিশুরা ভবিষ্যতের নাগরিক তারাই যদি মাদকের মত ভয়াবহ জিনিসে আসক্ত হয়ে যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ চিত্রই চোখের সামনে ভেসে উঠে। মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এই শিশুরা অর্থের পিছনে ছুটে। ফলে অর্থ জরুরি করতে গিয়ে তারা অপরাধ জগতের সাথে পরিচিত হয়। একটি অপরাধ থেকে অন্য অপরাধে জড়িত হতে হতে এক সময় স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে সরে যায় তারা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে শেষ পর্যন্ত খুন-হত্যার মত জঘন্য কাজে লিপ্ত হয় যা একজন শিশুর পক্ষে অচিন্তনীয় ব্যাপার। যারা এই পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেন তাদের মতে দারিদ্র মূলত পথশিশুদের নানাপ্রকার অপরাধের মূল কারণ। যে সব কারণে শিশুরা মূলত পথশিশুতে পরিণত হয় তাদের মধ্যে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা একাধিক বিয়ে, তাঁদের মৃত্যু, পারিবারিক অশান্তি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে পরিবার ও বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অন্যতম। তবে দারিদ্র ও পারিবারিক বন্ধনের অভাবেও ঘরের শিশুরা পথশিশুর পরিচয়ে চিহ্নিত হয়। মাদকাসক্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করে। এর মধ্যে পর্যাপ্ত নিরাময় কেন্দ্র না থাকা, মাদকাসক্ত শিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয়ের অভাব, মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসায় দক্ষ জনবলের অভাব, চিকিৎসা পরবর্তী পুনর্বাসনের অভাব ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সুব্যবস্থা করা যদিও কিছুটা কষ্টকর তবু সকলের সহানুভূতিই এই ব্যাপার অনেকটা সহজ করতে সহায় হবে।
আমাদের দেশে অনেকে পথশিশুদের জন্য নানা ধরনে সাহায্যকারী পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। কেউ ঈদের সময় নতুন পোশাক কিনে দেন, কেউ খেলাধুলার আয়োজন করেন, কেউ শিক্ষাসামগ্রী দিয়ে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, কেউ কর্মের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু যথাযথ পুনর্বাসনের অভাবে এসব পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদি কোন উপকারে আসে না। রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, রাস্তাঘাট, পথপ্রান্তর যে সব জায়গায় এই শিশুরা মাদক সেবন করে সেই জায়গাগুলো নিয়মিত তদারকির আওতায় আনা দরকার। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পারিবারিক বন্ধনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারকে একটি সুন্দর ও আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত গড়ে তুলতে হবে। মা-বাবা বা অভিভাবকের হাতে মার খেয়ে অনেক সন্তান পরিবার ছেড়ে নিজ জীবিকা অর্জনে লিপ্ত হয়। আদরহীন, মায়ামমতাহীন, পরিবারগুলোতে শিশুরা শুধু ঝগড়া বিবাদ দেখতে দেখতে জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এই ধরনের পরিবারিক অবক্ষয় রোধ করতে হবে।
প্রতিবছর একটি দিনকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে পালিত হয় পথশিশুদের অবস্থান তুলে ধরতে। আমাদের দেশে ২ অক্টোবর জাতীয় পথশিশু দিবস পালনের মাধ্যমে দায়বদ্ধতা প্রকাশ করা হয়। আমাদের সীমাবদ্ধ সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এই পথশিশুদের জন্য একটি স্থায়ী ঠিকানা তৈরি সকলের দায়িত্ব।
একেতো পথশিশু, তার উপর মাদকাসক্ত তাই আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের প্রয়োজন। শুধু দিবস পালনের মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্রই শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু তাদের দেখার কেউ নেই, একসময় অবহেলা, আদরে ও নির্যাতনে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য তারা মাদকের আসক্ত হয়ে পড়ে।
শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন ও স্বাস্থ্যের মত অধিকার থেকে বঞ্চিত এই পথশিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে এখনই মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসাও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করতে হবে। আর কোন পথশিশু যেন মাদকের সাথে জড়িত না হয় তার জন্য প্রতিটি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের রাষ্ট্রের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচনে দেশের আয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের খেলাধুলা বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন ছাড়া কোন ধরনের সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই আসুন সকলে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়াই।
লেখক:
রাজু আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, মিরপুর, ঢাকা
Mily