
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। মেধাভিত্তিক চাকরির দাবি পরিণত হয়েছিল গণ-অভ্যুত্থানে। এর পেছনে ছিল গণমানুষের ক্ষোভ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষরণ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন রাজপথে সোচ্চার তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নারীদের অকুতোভয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব। আন্দোলনের সম্মুখসারিতে শুধু পুরুষের কণ্ঠস্বর ছিল না, ছিল নারীর সাহসী অবস্থান এবং দৃপ্ত স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, গ্রামগঞ্জ কিংবা শহরের রাজপথে সর্বত্র নারীরা ছিলেন অগ্রভাগে। নারীদের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। কেউ পোস্টার লিখেছেন রাতভর, কেউ গোপন বৈঠকে অংশ নিয়ে পরদিনের কর্মসূচি নির্ধারণ করেছেন, কেউ পিকেটিং করেছেন কিংবা রাস্তার বাধা পেরিয়ে দৌড়েছেন বুলেটের মুখে। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিল একটাই স্পষ্ট বার্তা ‘এ দেশটা সবার, আমরা গণতন্ত্র চাই।’
জুলাই স্মৃতি উদযাপন উপলক্ষে ১৪ জুলাই ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ স্লোগানে দেশজুড়ে পালন করা হয় ‘জুলাই উইমেন্স ডে’। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের করা তালিকাতে ১০ জন নারীর নাম শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শহীদ ১০ জন নারীর মধ্যে ৭ জন রাজধানীতে, ২ জন নারায়ণগঞ্জে ও ১ জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৭ জনই গুলিবিদ্ধ হন নিজ বাসার বারান্দা ও ছাদে, ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সড়কে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক গণমাধ্যমে বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা ছিল সাহসী। গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তি ছিলেন নারীরা। আন্দোলনে ব্যাপকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ সবাইকে করেছে উদ্দীপ্ত, শক্তি জুগিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান এক নারী শিক্ষার্থী। এতে পুলিশ সেই শিক্ষার্থীকে ছাড়তে বাধ্য হন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলেছিল ব্যাপকভাবে। ‘চালান গুলি আমাদের উপরে, আমাদের টাকায় গুলি কিনে আমাদের বুকে গুলি চালান, আমার সন্তানের দিকে তাক করে বন্ধুক চালান, আপনার হাত ভেঙে দেব’ বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস। যার প্রতিটি শব্দচয়ন সমাজের বিবেকবান মানুষের অন্তরে নাড়া দিয়েছে এবং রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছে। অনেক মা রাস্তায় বিনামূল্যে খাবার দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের। পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক শিক্ষার্থীকে তখন মা তাকে যেভাবে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছেন, তা যেন পুরো জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তীব্র বার্তা দিয়েছে।
আন্দোলনে নির্যাতিত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন বহু নারী, কারাবরণ করেছেন তবু পিছু হটেননি। এমনকি নারায়ণগঞ্জে এক ছাত্রী জুলাইয়ের কথিত গুণ্ডাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। গণমাধ্যম বা সরকারি বিবরণে তাদের কথা উল্লেখ হয় না, সময় যেন এখনো পুরুষকেন্দ্রিক বয়ানের ঘেরাটোপে বন্দি। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী নারীদের ভূমিকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। নারীরা কোনো ‘সহযোগী শক্তি’ নয়, তারা ছিল আন্দোলনের সমান অধিকারভিত্তিক অংশ। তাই নারীর অবদানকে আড়ালে রাখা মানে ইতিহাসের অর্ধেক অস্বীকার করা।
প্যানেল/মো.