
ছবিঃ সংগৃহীত
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের পাহাড় ও সাগরে ভ্রমণে বেশ কিছু মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। একদিকে যেমন পাহাড়ের দুর্গম পথে ট্রেকিং করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে সাগরের উত্তাল ঢেউ বা তীব্র স্রোতে ভেসে মৃত্যুবরণ করেছেন বেশ কয়েকজন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো নিয়মিত বিরতিতে ঘটলেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুব একটা দেখা যায় না। দুর্ঘটনার প্রথম কয়েকদিন সচেতনতা ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হলেও পরবর্তী দুর্ঘটনা এসে দেখিয়ে দিয়ে যায় সব আছে আগের মতোই।
সম্প্রতি কয়েকটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। এখানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পেছনে যে কারণগুলো, তার মধ্যে প্রধান কারণ বলা যায়—ভ্রমণ পথের প্রতিকূলতা সম্পর্কে অসচেতনতা ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বা সরঞ্জাম ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ। ইদানীং বৃষ্টির দিনেই বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মতো পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা ট্রেকিংয়ের জন্য ছুটে যান, বিশেষ করে তরুণরা। কিন্তু প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, অনভিজ্ঞ গাইডদের উপর নির্ভর করে দুর্গম বা ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাত্রা করা হচ্ছে। অনেক সময় পর্যাপ্ত সরঞ্জাম বা প্রস্তুতি ছাড়াই পাহাড়ে ওঠা হয়, যা বিপদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। পাহাড়ি পথে আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন, আকস্মিক বন্যা বা ফ্লাশফ্লাড, ভূমিধস বা পথ হারানোর মতো ঘটনা ঘটলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে—এবং তা ঘটছেও।
পত্রিকার তথ্যমতে, গত ৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথে বেড়াতে গিয়ে পানির স্রোতে তলিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন দুই শিক্ষার্থী। এর কিছুদিন আগে পাহাড়ি ঢলে ভেসে গিয়ে মারা যান আরও তিন পর্যটক। এই দুর্ঘটনাগুলো যতটানা পরিস্থিতির কারণে, অনেকের মতে তার চেয়ে বেশি নিজেদের অসচেতনতা ও অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়ার কারণে। অন্য সময়ে পাহাড় কেবলই পাহাড় থাকলেও বর্ষাকালে এর কোনায় কোনায় থাকে ঝুঁকি। বৃষ্টিতে ধস নামার আশঙ্কা থাকে, ঝিরিতে আকস্মিক বন্যা ও তীব্র স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সবকিছু। থাকে বন্য প্রাণীর আক্রমণের ঝুঁকিও—বিশেষ করে রাতের বেলা পাহাড় আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে নানা কারণে।
অন্যদিকে, সাগরে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোও কম উদ্বেগজনক নয়। খবর অনুযায়ী, গত ৮ জুলাই কক্সবাজারের হিমছড়ি সমুদ্রে গোসল করতে নেমে শাদনান সাবাব রহমান নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। একই ঘটনায় নিখোঁজ হন আরও দুই শিক্ষার্থী। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আনাগোনা ঘটে। ছুটির দিনগুলোতে থাকে না তিল ধারণের জায়গা। এখানে আসা অনেকেই সাঁতার জানেন না বা স্রোতের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। খাল-বিল-নদীর সঙ্গে সমুদ্রের পানি ও স্রোতের পার্থক্য না জেনেই ঝুঁকি নিয়ে বসেন অনেকে। অনেক সময় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা অসচেতনতা জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। অনেকে আবার সমুদ্র সৈকতে সতর্কতা অমান্য করে বিপদজনক স্থানে গোসল করতে নেমে বা সাঁতার কাটতে গিয়েও বিপদে পড়ছেন।
সচেতনতার অভাবের সাথে এখানে আছে জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থার দুর্বলতাও। জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী জনবল ও উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব দূর করতে হবে, সেই সাথে ভ্রমণে আসা মানুষদের একটি সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা গাইডলাইনের মধ্যে রাখাও জরুরি।
সর্বোপরি, ভ্রমণে এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তিগত সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি সরকারি উদ্যোগও অপরিহার্য। পর্যটকদের উচিত ভ্রমণের আগে গন্তব্য সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া। পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের জন্য অবশ্যই অভিজ্ঞ গাইড এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম সঙ্গে রাখা। এখানে সতর্ক বেশি থাকা উচিত কারণ এখানে উদ্ধার চালানোও খুবই কষ্টকর ও ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। সাগরে গোসলের সময় স্রোত ও জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং সাঁতার না জানলে গভীর পানিতে না নামাসহ নানা ঝুঁকিগুলো প্রাথমিক সচেতনতার বিষয় হওয়া উচিত।
কর্তৃপক্ষকেও অবশ্যই প্রতিটি পর্যটন স্পটে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড ও উদ্ধারকারী দল নিয়োগ করতে হবে। বিপদজনক স্থানগুলোতে স্পষ্ট নিরাপত্তা নির্দেশিকা ও ভ্রমণকারীদের কাছে আবহাওয়াসহ প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যই করতে হবে।
পাশাপাশি জরুরি উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা জোরদার করা গেলে কমিয়ে আনা যেতে পারে দুর্ঘটনার ক্ষতি। সেই সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের পর্যটকদের সুরক্ষায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, কারণ তাদের ভৌগোলিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক সময় দুর্ঘটনা এড়াতে সহায়ক হতে পারে। অনিরাপদ ভ্রমণ পরিচালনা বা নিরাপত্তা নির্দেশিকা অমান্য করার ক্ষেত্রেও নেওয়া উচিত কঠোর আইনগত ব্যবস্থা।
লেখক:
নয়ন আসাদ,
লেখক ও সাংবাদিক
গাজীপুর সদর, গাজীপুর।
মারিয়া