
ছবি: সংগৃহীত
ভূ-প্রকৃতি গত ভাবে বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ। একে অন্যের প্রতি মায়া মমতা ও ভালোবাসার অনুভূতি কম থাকে না। এক জনের দুঃখকষ্টে হাজারো মানুষের অশ্রু ঝরে। তবে শুধু আবেগ নয় অস্তিত্বের সংকট হলে কি হতে পারে? যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। মেধায় চাকরি না পাওয়া কোটি কোটি যুবকের নিদারুণ নিষ্ঠুর কষ্টে জর্জরিত হৃদয়ে রক্তক্ষরণের প্রবাহের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে রাজপথে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল "বুকের ভিতর দারুণ ঝর! বুক পেতেছি গুলি কর" এ স্লোগান শুনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর গা জ্বলতে থাকে।
তাই তো দিবালোকে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছিল জুলাইয়ের বীর যোদ্ধা শহীদ আবু সাঈদকে। তৎক্ষনাৎ সারাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী আবু সাঈদের মর্মান্তিক হত্যার দৃশ্য দেখে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ চোখের জলে ক্ষোভে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে রাজপথে নেমে আসেন ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি ও জেলেসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। হাজার হাজার ছাত্রজনতার রক্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাধ্যমে দেশে আরেকটা গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। জুলাই আগস্টের ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থান এক শ্রেণির মানুষ বিপ্লব হিসেবে মেনে নিতে চায় না।
কারণ কোনো একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়নি বলে বিপ্লবী আন্দোলন বলতে কষ্ট হয় অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। কিন্তু বিপ্লব কি শুধু রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সংগঠিত হয়? আসুন এবার বিপ্লব বলতে কি বুঝায়? কোনো একটি নিদিষ্ট ভূখণ্ডের দেশে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন বা উল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়া, যা সাধারণত জনগণের অসন্তোষের ফলাফল হিসেবে ঘটে। তাকেই আমরা বিপ্লব বলি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে জুলাই- আগস্টের রক্তের মাধ্যমে অর্জিত বিপ্লব আমাদের বিপ্লবীরা বিপ্লবী সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জুলাইয়ে ঘোষণা পত্র ঘোষণা না হওয়ার কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। জনগণ আকাঙ্ক্ষা করেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বৈরাচারের কাঠামো পরিবর্তন হবে এবং ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিবর্তন হয়ে জনগণের জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থা নির্মাণ হবে। বর্তমান বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে দেশকে উন্নত কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাষ্ট্রের যে সকল কাঠামো শেখ হাসিনা হাদিস বানিয়ে রেখেছে সেগুলো পরিবর্তন,পরিমার্জন ও সংস্কার প্রয়োজন।
তার জন্য সবার ঐক্যমতের মাধ্যমে সম্ভব কিন্তু ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারছে না। সরকারের কার্যক্রম চালাতে পথে পথে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কথায় কথায় নির্বাচন আর নির্বাচন বলে আমরা ভুলে যেতে বসেছি ছাত্রজনতার রক্তে রঞ্জিত রাজপথের কথা। তখন স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে জুলাই-আগস্টে হাজার হাজার ছাত্রজনতা জীবন দিল শুধু কি একটা হযবরল-এর নির্বাচনের জন্য? আরেক গোষ্ঠী সংস্কারের কথা বলছেন! আসলে সংস্কার বলতে কি বুঝায়?
সংস্কার কমিশন" মানে হল কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা বা দুর্বলতা দূর করে সেটির উন্নতির জন্য গঠিত একটি কমিশন বা কমিটি। সাধারণত, সরকার বা কোনো সংস্থা এই ধরনের কমিশন গঠন করে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, যেমন - জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, শিক্ষা সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ১১টি কমিশন গঠিত হয়। স্বাধীন নিরেপক্ষ ভাবে কমিশন গুলো না হলে পুরনো বন্দোবস্ত বহাল থাকবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। দখলদারিত্বের রাজনীতিতে সাধারণ জনগণের হয়রানি বাড়ছে। জনগণ কি এগুলো চেয়েছে? দিনকাদিন কি ঘটছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি হরহামেশই চলছে। প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করতে প্রতিযোগিতা চলছে। বালু উত্তলন আর পাথর উত্তলন নিত্য দিনের সমস্যার সঙ্গী হয়ে আছে। গাছ কাটা, পুকুর দখল যেন পেশি শক্তির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় থেকে সমতলে নারী-শিশু নিপীড়ন, নির্যাতন এবং ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে।
গ্রামে গঞ্জে ভীতিকর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী করার চেষ্টাও চলছে সমানতালে। ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস আর শক্তি বিপন্নের পথে! অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা হচ্ছে জুলাইয়ের প্রেরণা জুলাইয়ের ফুল। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি। লাখো কোটি ছাত্র জনতা জগদ্দল পাথরের মত খুনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মানুষ আশায় বুক পেতেছে। সময় এসেছে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান সুরক্ষা দেওয়া। গ্রামেগঞ্জে পথে ঘাটে মাঠে বিপ্লবে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের কাজ করতে হবে। সামাজিক ভাবে নাগরিকদের সচেতন করতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে সুরক্ষা দিতে হলে শুধুমাত্র মুখের বয়ান আর খাতা কলমের দলিল পত্রে মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তার জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক ভাবে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণ জনগণের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।সেই সাথে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং সমাজের সর্বস্তরে সাম্য মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্পষ্টভাবে স্মরণ রাখতে হবে গণ-অভ্যুত্থানগুলোর মূল ভিত্তি হলো সাধারণ জনগণ। সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়। সেই মুক্তি হলো অর্থনৈতিক মুক্তি। ন্যায়বিচারের মুক্তি। নিরাপদে চলাফেরা এবং অধিকার আদায়ের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রবল ভাবে আকাঙ্খা প্রকাশ করে।
তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও গণঅভ্যুত্থানের শক্তির সমস্ত রাজনৈতিক দলকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের অধিকার সম্পর্কে জানাতে হবে এবং কীভাবে তারা তাদের অধিকার আদায় করতে হয় সে জন্য দেশের প্রতিটি ওয়ার্ডে সেমিনারের আয়োজন করা প্রয়োজন। এর পরে জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যে সকল মানুষ অন্যায় এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমাজে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে অপরাধমূলক তান্ডব চালায় তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক ভাবে শক্তভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর মানুষিকতা তৈরী করতে হবে।
দ্রুততার ভিত্তিতে যারা অন্যায় করেছে। তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল
কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লড়াই সংগ্রামের বাতিঘর। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। ফলে চরম ভাবে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে। বারবার বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান এসেছে। রাজপথে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরে। জীবন দানের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থান আসে। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়নি। সময় এসেছে জুলাই শিক্ষা দেয় অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ।
মানুষ সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে আর সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে জনগণের সকলের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। পুরোনো প্রথা ভাঙার মানুষিকতা তৈরী করতে জনগণ ও দেশের কল্যাণে সমাজের কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা দূর করে ন্যায় ইনসাফ ভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠনে কাজ করতে হবে। তার জন্য দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচাতে হবে। সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধের মানুষ তৈরী করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা এখন থেকে করতে হবে।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক চর্চা, ন্যায় বিচার ও জনগণের অধিকার সুরক্ষায় তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে কলেজ গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে সাম্যের বাংলাদেশ বনির্মাণে নতুন তরুণ নেতৃত্ব তৈরী হয়। তরুণদের নেতৃত্বে দেশে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পতন হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন করতে গিয়ে যারা আহত অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছে তাদের চিকিৎসা রাষ্ট্র এখনও নিশ্চিত করতে পারে নি। জুলাই আগস্টে হাজার হাজার ছাত্রজনতাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার বাংলার মাটিতে এখনও হয়নি।
এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কবে হবে?
বড় উদ্বিগ্নতার বিষয় না কি সাংবাদিক সাগর রুনির মত বছরের পর বছর শুধু ঝুলন্ত খবর দেখতে হবে। সাধারণ জনগণের মধ্যে সামান্যতম হলে পরিবর্তন এসেছে। মানুষ স্বৈরশাসকের কাঠামো দেখতে চায় না। এই সময়ে পরিবর্তন সম্ভব। তাই সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জুলাই- আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান বাঁচানো সম্ভব। তা না হলে জুলাইয়ে যারা জীবন দিল এবং আহত অবস্থায় মুমূর্ষু জীবন কাটাচ্ছে তাদের ঋণ কোনো শোধ হবে না বরং বেঈমানী করা হবে। বিভেদ নয় ঐক্য হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করার শপথ গ্রহণ করতে হবে।
লেখা: রাশেদুজ্জামান রাশেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
ছামিয়া