ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধর্ষণ বাড়ছে কেন

চম্পা আক্তার

প্রকাশিত: ২০:০৭, ১৩ জুন ২০২৫

ধর্ষণ বাড়ছে কেন

ধর্ষণ যেন আধুনিক সমাজে একটি নিত্যদিনের শব্দ। যার ভয়াবহতা আমাদের সংবেদনশীলতাকে আজ প্রায় অবসন্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা যেভাবে বেড়েছে, তাতে একে মহামারি না বলে উপায় নেই। প্রশ্ন ওঠে, এই সমাজে একজন নারী, শিশু বা কিশোরী কতটা নিরাপদ? আর ভয়াবহ প্রশ্নটি হলো- এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়? আদৌ কি এই সামাজিক ব্যাধি বন্ধ হবে?
চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৯৪ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী। তাদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুটি ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ শিশু, ১৭ কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিন কিশোরী ও ১৪ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন নারী। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে গত মাসে। 
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এমএসএফের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বেশি। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতো একই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রুপ ইউএনএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক, যৌনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। ২০২৫ সালের মার্চে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চে ধর্ষণের সংখ্যা ফেব্রুয়ারির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (MSF) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ৫৭। মার্চে ২৫টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যা ফেব্রুয়ারির ১৭টির তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। মার্চে ৬১টি চেষ্টা করা ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে, যা ফেব্রুয়ারির ১৯টির তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। 
ধর্ষণ শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম আঘাত। এই সামাজিক মহামারি রোধে প্রশাসনের ভূমিকা হতে হবে দৃঢ়, মানবিক ও সময়োপযোগী। শুধু মামলার পরিসংখ্যান ধরে রাখলেই হবে না, অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক নজরদারি, দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ এবং নির্যাতিতার প্রতি সংবেদনশীল সহায়তা। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিচারব্যবস্থা সব জায়গায় থাকা উচিত জবাবদিহিতা ও কার্যকারিতা। একই সঙ্গে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের উদ্যোগগুলো হতে হবে বাস্তবমুখী ও সর্বজনগ্রাহ্য। যখন মানুষ প্রশাসনকে নিজের আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখতে পাবে, তখনই সমাজে প্রকৃত নিরাপত্তা ও সুবিচারের বীজ বোনা যাবে। ধর্ষণ রোধে প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে সজাগ, সতর্ক ও সর্বোপরি ন্যায়ের পক্ষে।

চম্পা আক্তার 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

প্যানেল

×