ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক অঘোষিত শ্রেণিবিভাগ

ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ১২ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক অঘোষিত শ্রেণিবিভাগ

আমাদের সমাজে একটা অদ্ভুত বৈষম্য চলছে। নাম পাবলিক বনাম প্রাইভেট। আর এই বৈষম্যটা এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে, কারো উচ্চশিক্ষার জায়গাটা দেখে তার পুরো ভবিষ্যৎ কিংবা মেধা বিচার করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিবারে যেন এক উৎসবের আমেজ। অনেকটা ‘জাতির ভবিষ্যৎ এখন তৈরি হচ্ছে’ জাতীয় উল্লাস। অন্যদিকে যাদের ভাগ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়নি, তারা যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন শুরু হয় এক ভিন্নধর্মী লড়াই। কটাক্ষ, হেয় করার মতো বাক্যবাণ আসে নিজেদের পরিবারের দিক থেকেই। কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলা হয় প্রাইভেটে পড়বি? ভবিষ্যৎ অন্ধকার! নিজের খরচ নিজে চালাতে পারবি না, আবার ছাত্র? এই প্রশ্নগুলো যতটা না শিক্ষাবিষয়ক, তার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা ও হীনম্মন্যতা তৈরি করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গর্বের সংস্কৃতি আছে। সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই গর্ব যখন প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের খাটো করার অস্ত্র হয়ে ওঠে, তখন তা পরিণত হয় বর্ণবাদের এক ঘৃণ্য রূপে। একদিকে পরিবার, অন্যদিকে সমাজ- দুই দিক থেকেই এক অদৃশ্য চাপে পড়েন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এখানেই থেমে থাকে না বৈষম্যের চিত্র। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অহংবোধের দেখা মেলে। অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, ক্যান্টিন বা পরিবেশ নিয়ে অবজ্ঞার সুরে বলেন, ওই নোংরা জায়গায় বসে কীভাবে কেউ চা খায়? এমন মন্তব্যে স্পষ্ট হয়, শুধু পাবলিক না, প্রাইভেট শিক্ষার্থীরাও এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের মোহে আক্রান্ত, যেটা তৈরি হয়েছে গাঁটের টাকা আর তথাকথিত আরামদায়ক ক্যাম্পাস জীবনের দ্বারা।
বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকালে এই বিভাজনকে হাস্যকর মনে হয়। কারণ আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে এমআইটি, হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, ইউপেন, স্ট্যানফোর্ড, ক্যালটেক, কলাম্বিয়া, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো সবই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান।
তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব কোনো আরাম বা বিলাসের ওপর নয় বরং কঠোর পরিশ্রম, মান নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণার শৃঙ্খলার ফল। সুতরাং আমাদের সমাজে এই যে ‘পাবলিক বনাম প্রাইভেট’ মনোভাব, এটি মূলত অনর্থক এবং অনুৎপাদনশীল। জ্ঞান কখনও ‘পাবলিক’ বা ‘প্রাইভেট’ এই ট্যাগের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং বিভক্তির এই মানসিক কাঠামোই একে সংকুচিত করে তোলে। সমাজকে জানতে, গঠনমূলকভাবে চিন্তা করতে এবং উদারতা ধারণ করতে হলে এই মানসিকতার দেয়াল ভাঙতেই হবে। আমরা ভুলে যাই দেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ছাত্রজীবনে নিজ খরচ নিজেই চালায় ফ্রিল্যান্সিং করে, পার্টটাইম কাজ করে, টিউশনি করে। আবার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত আর্থিক সংকটে ভোগেন। অথচ তারা আবার দেশের সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক কাঠামো বিসিএস-এ সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব করেন। তেমনই, দেশে অধিকাংশ গবেষণার ভার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে। আন্তর্জাতিক জার্নাল, প্রবন্ধ, বা উন্নয়নমূলক প্রকল্প- সবকিছুতে তাদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি। অথচ রাষ্ট্রের উচ্চ পদ, সরকারি নিয়োগ কিংবা সামাজিক সম্মান সবকিছুতেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? পাবলিক না প্রাইভেট এই প্রশ্নে নয়। সমস্যাটা হলো- মানের সমতা না থাকা, শ্রেণি ও মর্যাদার ট্যাগ লাগিয়ে শিক্ষাকে বিভক্ত করে ফেলা। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার একটা মানদণ্ড থাকে। পাবলিক বা প্রাইভেট যেটাই হোক, শিক্ষকের মান, সিলেবাস, গবেষণার সুযোগ এবং ছাত্রের বিকাশ বই একটি নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলে। অথচ বাংলাদেশে এখনও এসব বিষয়ে সমন্বয়ের ঘাটতি প্রবল। একদিকে দেখা যায় কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট, শিক্ষক সংকট এবং রাজনৈতিক প্রভাব অতিমাত্রায় প্রকট।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বৈত সংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একটি রাষ্ট্র তখনই এগোয়, যখন তার শিক্ষা-ব্যবস্থা সকলের জন্য সমান সুযোগ ও মর্যাদা নিশ্চিত করে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য সনদ নয় মানুষ গড়ার প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় উদার, যুক্তিবাদী, চিন্তাশীল ও কর্মক্ষম নাগরিক। তাই আজ প্রয়োজন সামাজিক মনোভাবের বদল। শিক্ষার অঙ্গনে ‘প্রাইভেট বনাম পাবলিক’ নয়, বরং ‘সকলের জন্য মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা’ এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

লেখক : শিক্ষার্থী, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট
[email protected]

 

 

প্যানেল

×