
বর্তমান বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শব্দের কিংবা ধর্মীয় নির্দেশনার ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেলেও এর যথাযথ প্রয়োগ, সুবিধা-অসুবিধা, আইনগত বাধ্যবাধকতা, সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা বিরোধ, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক জটিলতা, নীতি শাস্ত্রের কিংবা নীতি বিদ্যার সঙ্গে যুতসই কি-না? ভার্চুয়াল দুনিয়া ও ট্রেডিশনাল দুনিয়ায় এর ব্যবহারিক জটিলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে যে আলোচনা সামনে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়- ‘হালাল’ ‘হারাম’ ‘নিষেধ’ ‘পাপ’ ইত্যাদি। প্রতিটি বস্তুর ভালো, সর্বজনীন গ্রহণীয় ও উপকারী বিষয়গুলো তুলে ধরার মাধ্যমে যেহেতু বাজারজাত করা হয় সেহেতু মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষের কাছে ‘হালাল’ ‘পাপ’ ‘হারাম’ ইত্যাদি শব্দগুলোর ব্যবহার গ্রহণীয়, বর্জনীয়, সম্মানীয় ও অতীব পবিত্র বলে বিবেচিত- এই ভাবনায় কোম্পানীগুলো তাদের পণ্য বাজারজাতকরণে উল্লিখিত শব্দগুলো ব্যবহার গ্রাহকদের সন্তুষ্টি কিংবা অসন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং বর্তমান সময়ে উল্লিখিত শব্দগুলো কেবল ধর্মীয় শব্দ নয়, মার্কেটিং অস্ত্রও বটে। বর্তমানে ‘হালাল’ বিষয়টাকে শুধু মৌখিক কিংবা কিতাবিক দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ না রেখে কীভাবে বিশ্বায়ন করা যায় সেদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘ইসলামিক ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন কাউন্সিল’, যা যুক্তরাজ্যে অবস্থিত। আই এস ও (ISO) যেমন একটি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে পণ্যের ওপর আস্থা আনা যায়, ঠিক তেমনি আই এফ এ এন সি এ (IFANCA- Islamic Food and Nutrition Council of America) একটি সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান- যা ‘হালাল’ শব্দটির প্রাতিষ্ঠানি গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে। বিশ্বব্যাপী ‘হালাল’ সার্টিফাইড প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিল মাত্র ২৩টি। বর্তমানে সেটা ২০০০ এর ওপরে (বাকের আহমেদ আলসাবহান, ২০১০)। সুতরাং বিপনণ প্রল্ডিয়ায় ‘হালাল’ শব্দটি এখন বিশ্বজনীন যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ম্যাক ডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট- সিংগাপুর, যা ‘হালাল’ সার্টিফিকেট অর্জন করার পর ২০% বেশি মুনাফা করে (চেং- ২০০৮)। ১৯৯৬ সালে ‘হালাল’ শব্দটি ব্যবহার করে এ্যারামেটিক সাবান ব্যাপক কনজিউমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী পর্যায়ে হালাল সাবানের সত্যতা প্রমাণের জন্য লিভার ব্রাদার্স (বর্তমানে ইউনিলিভার) কর্তৃক এ্যারোমেটিক সোপ ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশের আদালত একটি জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে এ্যারোমেটিক্সের পক্ষে মামলাটি খারিজ করে দেয় (জোবাল ২০০৩)। বিপণন পলিসি, কাস্টমার বিশ্লেষণ, দক্ষ জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট ইত্যাদি কারণে এ্যারোমেটিক সাবান টেকসই না হলেও হালাল শব্দটির ব্যবহারিক প্রয়োগ কতটা শক্তিশালি তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতা এবং বাস্তবতায় মাল্টিন্যাশলাল কোম্পানি যেমন- নেসলে, ইউনিলিভার, কে এফ সি, ম্যাক ডোনাল্ড ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম বিশ্বে হালাল শব্দটির নান্দনিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে কাস্টমার গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যাপক সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়।
পি কে মুভি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয় ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি অনুভব করেছেন। একই আগারবাতী মসজিদ ও মন্দির উভয়স্থানে ব্যবহার হয়, কিন্তু মোড়ক ভিন্ন, নাম ভিন্ন। যেমন- মদিনা, বেলাল দরবার ইত্যাদি নাম ব্যবহার হয় মসজিদে ব্যবহৃত আগরবাতীতে। আর আনন্দ, কল্পনা, নমস্তে ইত্যাদি নাম ব্যবহার করা হয় মন্দিরে ব্যবহৃত আগর বাতিতে। বাংলাদেশে হার্ডওয়ার ব্যবসায়ীর একটা বড় অংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাই তাদের দোকানে ‘ওম’ নামধারী দাঁড়িপাল্লা ও ‘গণেশ’ নামধারী কোদাল বিল্ডয় করতে বেশি দেখা যায়। এমনি অনেক উদাহরণ আছে যার মাধ্যমে বলা যায় ধর্ম কেবল বিশ্বাস নয়, এটি একটি অনুভূতি ও আস্তার নামও বটে। আর এ অনুভূতি আজকের নয়, হাজার বছরের পুরানো। হোমার বলেছেন- দেবতাদের বিচ্যুতির পথে টেনে নামানো এমন কোনো শক্ত ব্যাপার নয়, মানুষ যদি কিছু পাপ করে থাকে আর দেবতা হয়ে থাকে ল্ডোধান্বিত তাহলে একটু প্রার্থনা, কিছু সুরার উপঢৌকন, আর ভাজা চর্বির লোভনীয় গন্ধ- এটাই হবে যথেষ্ট দেবতার সেই ল্ডোধকে প্রশমিত করতে। (প্লেটোর রিপাবলিক, সরদার বজলুল করিম, পৃষ্ঠা-৮৪)
বিপণন ব্যবস্থাপনায় ‘পাপ’ কিংবা ‘হারাম’ শব্দ দুটি সতর্কতামূলক শব্দ। এগুলো যাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর বিপণনে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। যেমন- সনাতন ধর্ম অনুযায়ী গরু হলো- ‘পবিত্র প্রাণী’। সুতরাং গরুর মাংস খাওয়া পাপ। আবার ইসলাম ধর্মানুযায়ী পর্ক খাওয়া হারাম বা পাপ। সুতরাং গরুর মাংস, পর্ক এর মাংস, মদ- এগুলোর বিপনণ পলিসি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতির দিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। এলকোহল সংবলিত খাদ্যপণ্য ইসলামী নীতিমালায় কিংবা বিশ্বাসে অনুমোদিত নয়। কিন্তু অধিকাংশ কফ সিরাপ এলকোহল ধারণ করে। সুতরাং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এগুলো হারবাল সিরাপ নামে বিপণন করে।
আবার ‘ইসলামিক’, ‘শরীয়াহ মোতাবেক’, ‘পবিত্র’ ইত্যাদি শব্দগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এগুলোকে অনুসরণ করছে ইনসুরেন্স কোম্পানি, ঋণদানকারী ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ও বিপণন ব্যবস্থাপনা যাদের টার্গেটেড কাস্টমার হলো মুসলিম সম্প্রদায়। কিন্তু এর যে ব্যতিল্ডম নেই তা নয়। যেমন- বর্তমানে দুবাইয়ে ইসলামিক হোটেলের ৬০% কাস্টমার হলো নন-মুসলিম। বলা হচ্ছে ধর্ম সংস্কৃতির অংশ। কোনো কোনো দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রায়ই এক। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব, ইয়েমেন, কাতার ইত্যাদি, আবার বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এদেশের সাংস্কৃতির সঙ্গে ধর্ম অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক, আবার অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন- পহেলা বৈশাখ সংস্কৃতির অংশ হলেও সকল ধর্মের লোকজন বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এটা পালন করে এবং এর ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয়নীতি যত কার্যকর, তার চেয়ে বেশি কার্যকর সাংস্কৃতিক উৎসব। তাই যে কোনো দেশে পণ্য ব্যবস্থাপণার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মাথায় রাখা খুবই জরুরি।
ধর্মীয় সংবেদনশীলতার কথা চিন্তা করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সার্বিক বিবেচনায় গ্রহণীয় বিষয়াদির ওপর জোর দিয়ে থাকে। যেমন- কোকাকোলা মধ্যপ্রাচ্যে যে বিজ্ঞাপন চালায় সেখানে মডেলদের সেদেশীয় পোশাকেই দেখা যায় এবং একটি বিজ্ঞাপনের স্লোগান হলো- চেইঞ্জ হ্যাজ এ টেস্ট (Change has a taste)। আবার ইন্ডিয়ার কাস্টমার বিহেবিয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়- একটার সঙ্গে একটা ফ্রি। এর একটি বিজ্ঞাপনের স্লোগান হলো- ‘Taste The Feeling’।
ডিজিটাল মিডিয়ার বিস্তার ও প্রভাব ধর্মীয়ভাবে অনুভূতিশীল জনগোষ্ঠীকে যত প্রভাবিত করেছে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ধর্মীয়ভাবে শ্রেণিবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে। যেমন- বাংলাদেশে সকল ধর্মের লোকজনের সহঅবস্থান থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে ও নিজেদের মধ্যে পণ্য বিনিময়ে বা বিপণনে অধিক বেশি তৎপর। যেমন- ঈদের সময় মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ ধরনের শুভেচ্ছা কার্ড (ডিজিটাল) বিনিময় করে। ঠিক তেমনি হিন্দু সম্প্রদায় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় উৎসব ও পার্বণে নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক ব্যবহার করে।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ধর্ম ও বাণিজ্য সহঅবস্থান করছে। যেমন- থাইল্যান্ডে ব্যবসাবাণিজ্যে উন্নতি করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধের মূর্তিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিঙ্গাপুরে হিন্দু ধর্মীয় লোকজনের ধর্মীয় অনুভূতির কথা চিন্তা করে একটি বড় ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে। চায়নায় কুইংমিং ফ্যাস্টিভাল বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখানে বলা হচ্ছে ‘যারা পাপ নিয়ে মারা যাবে তারা মৃত্যুর পর খেতে পারবে না, কিন্তু কুইংমিং উৎসবের দিন খেতে পারবে’।
ধর্মীয় নীতি অপরিবর্তনীয়, বাজার ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনশীল। সুতরাং স্থির ধারণার সঙ্গে পরিবর্তনশীল ধারণার সংযোজন ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেজন্য ধর্মীয় বিভাজনও লক্ষ্য করা যায়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশে বিভিন্ন ইসলামিক গোষ্ঠী। যেমন- তাবলিগ, জাকের পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, মাজারকেন্দ্রিক ইসলাম ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে ‘হালাল’ খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে- ০৬টি (বাকারা, মায়িদাহ, আন-আম, আরাফ, নাহল ও হজ) সূরাতে বলা হয়েছে- যার মর্মার্থ একই, কিন্তু এর মূল ভাবার্থ বিশ্লেষণে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করে। সুতরাং রিলিজিয়ন মার্কেটিং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের নিকটও গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের বাজার ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শব্দ কিংবা বাক্যের উপস্থিতি গুগল, ফেসবুক বা টুইটারের মতো জনপ্রিয়তা না পেলেও এগুলো কিন্তু ধর্মীয় সুপার মার্কেটের কাজ করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা ধর্মের প্রতি তেমন বিশ্বাস করে না, কিন্তু একটি মানুষও পাওয়া যাবে না যে টাকায় বিশ্বাস করে না। সুতরাং পরিবর্তনশীল বিপণন ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় অনুভূতির প্রয়োগ গ্লোবাল মার্কেটিং এ যুতসই অবস্থান তৈরি করতে পারবে না; তবে বড় একটি মার্কেট শেয়ার নিতে পারবে। এহেন প্রেক্ষাপটে একটি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সে রিজিওনালি অবস্থান করবে না গ্লোবালি। ধর্মীয় বিপণন ব্যবস্থার রিজিওনালি অবস্থান আর্থিকভাবে যুতসই হলেও গ্লোবালি হবে দুর্বল, যা পরিশেষে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কোকাকোলাকে ঠেকাতে মার্কেটে আসে ‘মক্কা কোলা’, জমজম কোলা, কিবলা কোলা কিন্তু কোকা কোলার বিশ্বায়ন অবস্থান থাকলেও অন্যদের নেই। সুতরাং ধর্মীয় বিপণন ব্যবস্থাপনায় পণ্যের আঞ্চলিক অবস্থানকে বিশ্বায়ন করতে আগে প্রয়োজন ধর্মীয় শব্দ কিংবা ধর্মীয় নীতির বিশ্বায়ন।
লেখক : বিপণন গবেষক
প্যানেল