ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

ন্যায্য মজুরি ও মর্যাদা : শ্রমিকের প্রাপ্য দাবি

মো. সাকিব উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৭ মে ২০২৫

ন্যায্য মজুরি ও মর্যাদা : শ্রমিকের প্রাপ্য দাবি

চলছে শ্রমিক দিবসের মাস। প্রতি বছরের মতো এবারও পালিত হয়েছে এই বিশেষ দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে। মিছিল, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা সবই ছিল আয়োজনের অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত আয়োজন, এত স্মরণ, এত সংগ্রামের পরও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি কি আদৌ পূরণ হয়েছে? উত্তরটা আজও নেতিবাচক। এখনো বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মৌলিক মানবাধিকারের বাইরে রয়ে গেছেন।
শুরু করি কৃষকের ঘামের অবদান দিয়ে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ (উইকিপিডিয়া)। কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা কিয়াক সুং-এর মতে, বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। পাট রপ্তানিতে আমরা প্রথম (যুগান্তর ২০২৪) এবং আম উৎপাদনে সপ্তম (ইত্তেফাক)। এই সকল অর্জনের পেছনে মূল কারিগর হচ্ছেন শ্রমিকরাÑ এই দেশের অক্লান্ত পরিশ্রমী মানুষ।
তবুও তারা রয়ে গেছেন উপেক্ষিত। ধান, পোশাক, পাটসহ নানা পণ্যের উৎপাদনে অবদান রেখেও শ্রমিকরা এখনো বঞ্চনার শিকার। আজও অসুস্থ হলে হাসপাতালমুখো হতে ভয় পান সুমি পারভীন, মিরাজদের মতো পরিশ্রমীরা। কারণ চিকিৎসা খরচ জোগানো তাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন।
ন্যায্য মজুরি মানে শুধু টাকার অঙ্ক নয় এটা একটি সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা। একজন শ্রমিক সমাজে বসবাস করেন। সুতরাং মজুরি নির্ধারণও হওয়া উচিত সেই সমাজের অবস্থা ও ব্যয়ের বিবেচনায়। নারী-পুরুষ সমান মজুরি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আজও দেখা যায়, সমান কাজ করেও নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পান- যা এক প্রকার লিঙ্গবৈষম্য।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যেখানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে। অথচ এ খাতে কর্মরত শ্রমিকরা মাসে পান মাত্র ১২-১৫ হাজার টাকা। ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে এই আয় টিকে থাকাও কঠিন। তার ওপর নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা, ওভারটাইমের চাপ, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সব মিলিয়ে তাদের জীবন যেন একটি নীরব যুদ্ধ।
শুধু আর্থিক বঞ্চনা নয়, শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত সম্মানজনক আচরণেরও অভাবে ভোগেন। শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশ তাদের দেখে অবজ্ঞার চোখে। গালাগালি, অপমান, অমানবিক আচরণ যেন শ্রমিক জীবনের নিত্যসঙ্গী।
২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইন ২০১৮ সালে সংস্কার করা হলেও বাস্তব প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ। আইনে কর্মঘণ্টা নির্ধারিত ৮ ঘন্টা হলেও বাস্তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৯ ঘণ্টা। শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় অসম্ভব। কারণ চাকরি হারানোর ভয়, মামলা এবং দমননীতির কারণে শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে পারেন না।
এক সময় শ্রমিক আন্দোলন ছিল শক্তিশালী। পাকিস্তান আমলে শ্রমঘণ্টা কমানো ও মজুরি বৃদ্ধির মতো দাবি আদায় সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব, নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বিভক্তি শ্রমিক সংগঠনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কিছু ত্যাগী নেতা এখনো লড়ছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আন্দোলন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
সম্প্রতি গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছে যেমনÑ তিন বছর পরপর জাতীয় মজুরি নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে সমন্বয়, বেতন বিলম্বে ক্ষতিপূরণ, আপৎকালীন তহবিল, ইউনিয়ন গঠনের শর্ত শিথিলকরণ, আউটসোর্সিং বন্ধ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীতকরণ, শ্রম আদালতের সংস্কার এবং ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
এই প্রস্তাবগুলো নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এগুলোর বাস্তবায়নে সরকার কতটা আন্তরিক? কারণ, অতীত দেখিয়েছে, আইন থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর হয় না। মালিকপক্ষের বিরোধিতাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, শ্রম আদালতের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে, শ্রম আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনের জনবল ও প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে। নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্রমিকের জন্য সামাজিকভাবে সম্মানজনক মজুরি নির্ধারণ করা। তাদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে হবে। কারণ শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিকে সেবা দিচ্ছেন। তাদের সুস্থতা মানেই অর্থনীতির সুস্থতা। শ্রমিকদের সম্মান দিতে হবে, তাদের মতামতকে মূল্য দিতে হবে। তারাও নাগরিক। তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সরকার, মালিক ও শ্রমিক সবার সমন্বিত উদ্যোগেই গড়ে উঠতে পারে একটি টেকসই ও মানবিক শ্রমনীতি। মনে রাখতে হবে, শ্রমিক বাঁচলে মালিক বাঁচবে। মালিক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে দাঁড়ানো অর্থনীতিকে যদি আমরা সম্মান করি, তাহলে তাদের ঘামকেও সম্মান করতে হবে। ন্যায্য মজুরি শুধু অর্থনৈতিক দাবি নয় এটা মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বও বটে।
শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।
[email protected]

প্যানেল

×