ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

প্রসঙ্গ মানবিক করিডর এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসন

জুবায়ের হাসান

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ৭ মে ২০২৫

প্রসঙ্গ মানবিক করিডর এবং রোহিঙ্গা সংকট নিরসন

বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে মানবিক করিডর স্থাপনের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে গত মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকালে। জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে ১৫ মার্চ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে। আরাকান আর্মিও এখন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের সঙ্গেও প্রয়োজনীয় সংলাপ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি যে, অতীতে রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক সহজ ছিল না।’
এদিকে গত ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এক সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে জানান যে, এ বছরের প্রথমার্ধে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছিল জাতিসংঘ। এ জন্য গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের কাছে জাতিসংঘ করিডর দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে কারণ এটা একটা হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের) পথ হবে। তবে বাংলাদেশের সম্মতিতে কিছু শর্ত রয়েছে। সেসব শর্ত যদি পালিত হয় বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করবে। (সূত্র : রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের, দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫)।
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান ২৯ এপ্রিল ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে  বলেন, ‘রাখাইনে জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ তাতে কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহী আছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের সহায়তায় মানবিক সহায়তার মাধ্যমে রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা শরণার্থীদের ফেরার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। তবে মানবিক সহায়তার রুটের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে, যা নিয়ে নানা পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন।’ (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০২৫)।
মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এ দুজনের বক্তব্যকে ঘিরে দেশব্যাপী এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে বিতর্ক শুরু হয়। এদিকে ২৯ এপ্রিল বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম করিডর বিষয়ে আরেকটি বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। আমাদের অবস্থান হলো, জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে যদি মানবিক সহায়তা প্রদান করা হয়, তবে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে আগ্রহী থাকবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে তীব্র মানবিক সংকট চলছে। দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশকে সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারকে সহায়তা প্রদান করা। প্রেস সচিব সতর্ক করে বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন যে, এ ধরনের মানবিক সংকট দীর্ঘ হলে রাখাইন থেকে আরও মানুষের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, যা আমরা সামাল দিতে পারব না। অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বাস করে যে, জাতিসংঘ-সমর্থিত মানবিক সহায়তা রাখাইনকে স্থিতিশীল করতে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর বাস্তবসম্মত একমাত্র পথ হলো বাংলাদেশ। এই রুট ব্যবহার করে সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে লজিস্টিক সহায়তা প্রদানে সম্মত রয়েছে। তবে রাখাইনে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যথাসময়ে আমরা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করব। (সূত্র: মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি : প্রেস সচিব, বাসস, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
সুতরাং প্রেস সচিবের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মধ্যে মানবিক করিডর স্থাপনের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার এখনো নেয়নি। কিন্তু এ প্রসঙ্গে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। তারা মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করছে।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৮ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের এক পথ সভায় বলেন, আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আর যুদ্ধ দেখতে চাই না। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৮ এপ্রিল)। ওই একই দিন রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ভীষণ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল)। ওই বৈঠকে দলটির নেতারা মনে করেন, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি অনির্বাচিত সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। (দৈনিক সমকাল, ৩০ এপ্রিল)। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর শরীয়তপুরে এক গণসংযোগ অনুষ্ঠানে বলেন, যদি করিডর বাস্তবায়ন হয় তাহলে সব দল মিলে আমরা এটি প্রতিহত করব। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ এপ্রিল)। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আমির ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না। এর নিন্দা জানাই। আমরা এর প্রতিবাদ জানাব। (বিবিসি বাংলা, ২৯ এপ্রিল)। জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ-সভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র মহান মে দিবসের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, মানবিক করিডর দেশের জন্য অমানবিক হতে পারে। (প্রথম আলো, ১ মে)। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা বৃহৎ শক্তির কোনো দ্বৈরথে পড়তে চাই না। (প্রথম আলো ২ মে)। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত স্থগিতের দাবি জানানো হয়। (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল)। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ২৮ এপ্রিল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের পোস্টে লিখেন, রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তা বিষয় জড়িত থাকতে পারে। (বিবিসি বাংলা ২৯ এপ্রিল)।
মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রচণ্ড বিরোধিতা করলেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসন কিভাবে হবে সে বিষয়ে কোনো রূপকল্প তারা জাতির সামনে এখনো পর্যন্ত তুলে ধরতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের নির্ভয়ে ও নিরাপদে স্থায়ীভাবে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এসব রাজনৈতিক দল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি ধরনের পদক্ষেপ নেবে সেটিও দেশের মানুষের কাছে অজানা। জাতিসংঘের সঙ্গে সহায়তা না করে এবং বিদেশী অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে রোহিঙ্গা সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে সেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলছে না। গত ২৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন করে ৭৩ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তায় ঘোষণা দেয়। এই সহায়তা প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে কি উপায় অবলম্বন করবে, তার পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে না। এছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে রাখাইন থেকে দলে দলে আরও রোহিঙ্গা এবং রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ঢল যদি বাংলাদেশে এসে পড়ে সে পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করা যাবে তা একটি বড় চিন্তার বিষয়। ইতোমধ্যেই নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে। বস্তুত এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এই দাঁড়িয়েছে যে, যখন যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন তারা পুরো দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মেঠো বক্তৃতা করে এবং জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনতে খেয়ালখুশি মতো কথাবার্তা বলে। গত ৫৪ বছরে নির্বাচিত-অনির্বাচিত উভয় ধরনের সরকার দেশের ক্ষমতায় থেকেছে। সব আমলেই রোহিঙ্গা সমস্যার কম বেশি উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু কেউ-ই এর কোনো স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি। এর বড় কারণ মিয়ানমারের সরকার কখনোই রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে অতীতে চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসন সাময়িক হয়েছে। মিয়ানমারের জান্তার দ্বারা রোহিঙ্গারা পুনর্বার নিপীড়িত হয়েছে এবং তারা আবার বাংলাদেশে এসেছে।
গণহত্যার শিকার হয়ে রাখাইনের (আরাকান) রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে বড় ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটে অন্তত চারবার। সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সাল, এরপর ১৯৯২, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে। ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ২ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের আবাসভূমিতে ফেরাতে সক্ষম হন। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকার এক চুক্তির মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে ২০১২ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে আর ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের অঘোষিত মুরব্বি এবং শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। হাসিনার আমলে (২০০৯-২০২৪) এদেশে চলে ব্যাপক জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা ও অভিযান। বলা হয়, জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য একমাত্র হুমকি। অথচ এরই ফাঁকে ২০১২, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে আরাকান বা রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমরা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে তাদের সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। তারা কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বঙ্গোপসাগরের ভাসান চরের শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছেন। এভাবে কয়েক লাখ নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গা  লোকজন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ায় এদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বড়ই বিপদে পড়ে যায়। কিন্তু সে বিপদ কাটিয়ে ওঠার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি শেখ হাসিনার সরকার। ভারত শুধু বাংলাদেশের কথিত পরম বন্ধু হয়েই থেকেছে। কোনো কাজে আসেনি। শেখ হাসিনা কিছুটা কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ করলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন- দু’দেশের কাউকেই বাংলাদেশের পক্ষে আনতে পারেননি। বস্তুত ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিলো। ভারত চেয়েছিল রোহিঙ্গা সমস্যা চলমান থাকুক যাতে বাংলাদেশের নাজুকতার সুযোগ নিয়ে এদেশের ওপর আরও খবরদারি বিস্তৃত করা যায় এবং এদেশের জনগণ তীব্রভাবে চীনবিরোধী হয়ে ওঠে।
২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঢল নামার পর শেখ হাসিনা ওই বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে এক চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ২০২২ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা বিষয়ে রেজুলেশন পাস করে। রোহিঙ্গাদের পক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্যদের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কিংবা মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি এসবের কোনোটাই তাদের দেশে ফেরা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ কারণে হতভাগ্য এই জনগোষ্ঠী দিন দিন হয়ে পড়ছেন হতাশ ও বিমর্ষ। পৃথিবীর সব শরণার্থী শিবিরেই সংগঠিত হয় নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড। বিস্তীর্ণ বস্তি এলাকায় যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনের আবির্ভাব হয় শরণার্থী শিবিরগুলোতেও তেমনই ঘটে। এতে হুমকিতে পড়ে আশ্রয় দানকারী দেশের জাতীয় নিরাপত্তা। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে চোরাচালান, মাদক ব্যবসা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকার পাতায় প্রায়ই প্রকাশ হয়। এছাড়া শরণার্থী শিবিরের অনেকে মিয়ানমারের ওপর প্রতিশোধ নিতে অস্ত্র হাতে নেওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এটা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। আরও চিন্তার বিষয় হলো, মিয়ানমারও এটাকে অজুহাত বানিয়ে ক্রস বর্ডার অপারেশনের নামে বাংলাদেশের ওপর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করতে পারে। এমনকি মিয়ানমার উভয় দেশের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’কে সম্প্রসারিত করে বাংলাদেশেরই অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার উল্টো প্রস্তাব হাজির করতে পারে। এছাড়া মিয়ানমার কর্তৃক বাংলাদেশের ভূমি দখলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের কর্মকাণ্ড এবং ওপার থেকে মিয়ানমারের শ্যেন দৃষ্টি এমন দ্বিমুখী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ায় তাদের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ হুমকির মুখে পড়েছে। আরাকান আর্মি প্রায়ই বাংলাদেশী জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নাফ নদীতে চলাচলকারী বাণিজ্য জাহাজের ওপর শুল্ক কর আদায় করছে। এতে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশকে দুইবার মাসুল গুনতে হচ্ছেÑ প্রথমত জান্তা সরকারকে এবং দ্বিতীয়ত আরাকান আর্মিকে। অতএব  রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এমতাবস্থায় মানবিক করিডর স্থাপন করলে নতুন করে কতটা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে না-কি মানবিক করিডর স্থাপনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপে ফেলে তা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পথকে সুগম করবে, এ দুইয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ জরুরি।
এতগুলো বছরেও রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হয়নি। মিয়ানমারের বেপরোয়া নীতির কারণেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে। এই দীর্ঘ সময় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও ওলট-পালট হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট যখন শুরু হয় তখন আউং সান সুচি ক্ষমতায় ছিলেন। ২০২১ সালে সামরিক জান্তা তাঁকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এরপর ২০২৩ সালে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি সেই রাখাইন রাজ্য বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে। মিয়ানমারের এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সেখানে ফিরে যাওয়া পূর্বের তুলনায় আরও কঠিন হয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার অতীতের প্রতিশ্রুতিগুলো ভঙ্গ করে তারা একটি অবিশ্বস্ত প্রতিপক্ষ হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করেছে।
অন্যদিকে আরাকান আর্মি একটি অ-রাষ্ট্রিক বিদ্রোহী শক্তি। তারা যে রাখাইনে তাদের দখল বজায় রাখতে পারবে সেটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী বিমান ও ড্রোনের সাহায্যে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করলে আরাকান আর্মি পিছু হটতে পারে। খুব সম্ভবত চীনের মধ্যস্থতার কারণে বর্তমানে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। উল্লেখ্য, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী (তাতমাদো) উভয়ই রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রচণ্ডভাবে বৈরী। তাই বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান জটিল আকার ধারণ করেছে।
(আগামীকাল সমাপ্য)
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

প্যানেল

×