ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

আমার জিন্দেগীতে উনার প্রভাব পিতামাতার চেয়েও বেশি: শিশির মনির

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ৮ মে ২০২৫

আমার জিন্দেগীতে উনার প্রভাব পিতামাতার চেয়েও বেশি: শিশির মনির

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে আবেগঘন স্মৃতিচারণ করেছেন সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

রবিবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইবনে সিনা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তিনি একসময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। পরে এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, “কোন মানুষকে উনি কখনো রাগাতেন না। কিন্তু ঠিকই জবাব দিতেন। আমি যদি একটু কোন কারণে উত্তেজিতও হতাম উনি আমাকে বলতেন চুপ থাকো, বসে থাকো। দেখো আমি কি করি। শেষ পর্যন্ত যত বিচারকই উনাকে বাঁকা প্রশ্ন করতেন না কেন, উনি কোন প্রশ্নে উত্তেজিত হতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি ঠিকই উত্তর দিতেন। উনি খুব মাইল্ড ছিলেন। সাবমিসিভ। কিন্তু খুব বোল্ড। উনি বলতেন আমি যা বলছি এটা খুব শক্তিশালী ভাবে বলছি। কিন্তু আমি আস্তে বলছি। আমার কথাটা অনেক জোরালো। কিন্তু আমার ভয়েসটা এত উঁচু না।”

শিশির মনির আরও বলেন, “তো মনে হতো যে প্রতিক্ষণই উনি কিছু না কিছু আমাদেরকে শিখাতেন। এমনও হয়েছে আমি উনার শিয়রের পাশে বসে থাকতে থাকতে রাত চারটা বেজে গেছে। আমাকে বলছেন তোমাকে আমার এটা পড়াইতে হবে। তো আমি উনার পাশে বসে আছি। উনি ঘুমায় পড়ছেন। আমি উঠে যাইনি। হঠাৎ করে উনি ঘুম ভেগে দেখেন রাত চারটা বাজে। তো আমাকে বলছে তুমি এখনো বসে আছো কেন? আমি বললাম যে আপনি আমারে যাইতে বলেন নাই। সেজন্যই আমি এখানে বসে আছি।”

তিনি উল্লেখ করেন, “কাদের মোল্লার মামলায় যখন রিভিউ পিটিশন শুনানি হলো, তখন জেল গেটে আমরা গেলাম। রাত সাড়ে টায় ফাঁসি হয়ে যাবে। আমরা জজের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখলাম জজ সাহেব লুঙ্গিপুরে বসে আছে। বসে থাকা অবস্থায় উনি আর খন্দকার মাহবুব হোসেন। জজ সাহেবের বাসার ভিতরে গেলেন। আমি সাথে গেলাম। লুঙ্গি পড়া অবস্থায় জজ সাহেব অর্ডার দিলেন। তখন জজ সাহেব লুঙ্গি পড়ে বসে আছেন তার ড্রইং রুমে। এখান থেকে জেল গেটে গেলাম। ফাঁসি আটকালো। ১০ই ডিসেম্বর।”

তিনি আরও জানান, “১১ই ডিসেম্বর উনি চেম্বারে যাওয়ার পরে আমাকে বললেন যে সারা রাতে শেষ হবে না তুমি আমাকে ফজরের পরে বাসায় এসে বোঝাবা। আমি বাসায় গেলাম তখন পাঁচটা বাজে ভোর পাঁচটা। ভোর পাঁচটা থেকে আবার স্যারের বাসায় আসলাম তখন সাড়ে সাতটা বাজে। এসে দেখি স্যার অপেক্ষা করতেছেন নাস্তা নিয়ে। নাস্তা খেলাম। ওনাকে আমি বুঝালাম। ওনার এক ছেলে ছিলেন, উনি বুঝালেন। তারপর আমরা আবার সুপ্রিম কোর্টে গেলাম কাদের মোল্লার মামলার রায়ের রিভিউ চলবে কি চলবে না এই প্রশ্নে।”

ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে শিশির মনির বলেন, “ফলে আমি ভাবছি কিছু একটা লিখবো এবং লিখলে বই হবে। অনেক ইন্টারেস্টিং, অনেক শিক্ষণীয়, অন্য ধরনের। পার্সোনালিটি স্বাভাবিক মানুষের মত না। উনার ব্যক্তিত্ববোধ সব মানুষের চেয়ে আলাদা। আমি অনেক আইনজীবীর সঙ্গে কাজ করেছি, অনেক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে, কিন্তু এইরকম প্রভাব ক্রিয়েট করতে পারে জুনিয়রদের উপরে কিংবা আদালতের উপরে,তার দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি আমি দেখিনি।”

তিনি বলেন, “উনি দেখতে অনেক লম্বা ছিলেন। উনি যখন কোর্টে দাঁড়াতেন তখন সবার উপর দিয়ে উনার মাথা দেখা যেত। আবার উনি যখন বলতেন তখন স্পষ্ট করে বলতেন। পিছনে আইনজীবীরা বলতো, যতক্ষণ উনি বলতেন, সুপ্রিম কোর্টে আমি দেখেছি পিন পতন সাইলেন্ট। কেউ কোন শব্দ করে না। উনি বলা শেষ, মনে হলো যেন নাটক শেষ হয়ে গেছে। এরকম একটা মানসিকতা বা এরকম একটা টেন্ডেন্সি আর সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব পাওয়া যাবে কিনা, আল্লাহই ভালো জানে।”

ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে এক অপূরণীয় ক্ষতির অনুভূতি প্রকাশ করে শিশির মনির বলেন, “ফলে এটা অপূরণীয় ক্ষতি। আপাতত তা পূরণ করা সম্ভব নয়। আর সেকেন্ড হলো, ব্যক্তিগতভাবে আমরা তো খুবই ইমোশনাল। উনার দুই সন্তান আর আমি এত ওতোপ্রতভাবে আমরা জড়িত ছিলাম, মনে হতো যেন একটা পরিবার।”

তিনি স্মরণ করেন, “আমার মনে আছে একটা খুব ইম্পর্টেন্ট ঘটনা। আমার ওয়াইফ যখন প্রথম বাচ্চা ধারণ করে তখন অসুবিধা হয়। স্কয়ার হাসপাতালে আমার ওয়াইফকে ভর্তি করেছি। উনি আমাকে ঘণ্টায় পাঁচবার ফোন দিতেন,কি হইছে? এখন কোথায় হইছে? এখন কোথায় আছো? এখন আমি আসবো। এখন কি থিয়েটারে নিছে কিনা? আমি ভাবতাম যে, কি করে পসিবল একজন মানুষ তার জুনিয়র আইনজীবীর প্রতি এত পরিমাণ এটেনশন কি করে দেয়?”

শিশির মনির বলেন, “এগুলো বইলেও শেষ করা যাবে না। এগুলো অনুভূতি। শুধু অনুভূতি থেকে যাবে। এবং উনি আমার জিন্দেগীতে উনার প্রভাব আমার পিতামাতার চেয়েও বেশি,যা অতুলনীয়।”

উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের এই প্রস্থানে শুধু আইন অঙ্গনে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কেও গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তার সহকর্মীরা।

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/yj24kcyw

আফরোজা

×