
আধুনিক শহরজীবনে ছিনতাই একটি চরম উদ্বেগজনক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি একটি এমন অপরাধ, যা মুহূর্তেই একজন নিরীহ মানুষের আর্থিক ও মানসিক স্থিতি তছনছ করে দিতে পারে। আজকের ব্যস্ত নগরজীবনে ছিনতাই যেন এক নিত্যদিনের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো সংবাদপত্রে ছিনতাইয়ের ঘটনা উঠে আসে এবং এর ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শহরের ব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে নির্জন গলি, গণপরিবহন থেকে শুরু করে ফুটপাথÑ কোথাও যেন নিরাপদ বোধ করছে না সাধারণ মানুষ। ছিনতাইয়ের ঘটনা সাধারণত খুব দ্রুত ও হঠাৎ ঘটে, যাতে ভুক্তভোগীর প্রতিরোধ করার সুযোগ কম থাকে। ছিনতাইকারীরা অনেক সময় অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে, এমনকি প্রতিরোধ পেলে তারা আঘাত করতে দ্বিধা করে না। ফলে অনেক সময় মূল্যবান জিনিস হারানোর পাশাপাশি আহত হওয়া বা প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। বিশেষ করে নারীরা, শিক্ষার্থীরা এবং বয়স্করা ছিনতাইয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই আতঙ্কের কারণে মানুষ অনেক সময় বাইরে যাওয়া, বিশেষ করে রাতে বের হওয়া এড়িয়ে চলে। এই ভয়াবহ সমস্যার মূল শিকড় খুঁজে দেখলে সমাজের নানা অসংগতি আমাদের চোখে পড়ে। ছিনতাইয়ের পেছনে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক কারণ জড়িত। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, অপরাধপ্রবণ পরিবেশ, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্বল পারিবারিক কাঠামো এবং বিচারহীনতা এই অপরাধকে বাড়িয়ে তুলছে। আবার কিছু সংগঠিত অপরাধী চক্র থাকে, যারা পরিকল্পিতভাবে তরুণদের কাজে লাগিয়ে ছিনতাই চালায়। এর পাশাপাশি সমাজে নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং পারিবারিক নজরদারির দুর্বলতা এই অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। পরিবারের ভেতরে যখন শিশুরা ভালো ও খারাপের পার্থক্য শেখে না, তখন তাদের মানসিক গঠন দুর্বল হয় এবং তারা সহজেই অপরাধের প্রতি আকৃষ্ট হয়। স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে, ফলে তরুণ প্রজন্ম ন্যায়ের চেয়ে সুযোগকেই বেশি প্রাধান্য দিতে শিখছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবও ছিনতাই বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। অনেক সময় অপরাধী ধরা পড়লেও আইনি জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তারা ছাড় পেয়ে যায়। এতে তাদের মধ্যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। আবার কখনো কখনো ছিনতাইকারীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পায়, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে সাধারণ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হারায় এবং অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। প্রথমত, তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করতে পারলে তারা অপরাধের পথে হাঁটবে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও নাগরিক চেতনার চর্চা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিশুদের শৈশব থেকেই সত্য, ন্যায়, দায়িত্ব ও সহমর্মিতা শেখাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দক্ষ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও জনবান্ধব করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, রাত্রিকালীন টহল জোরদার এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা গার্ড নিয়োগ করতে হবে। ছিনতাইকারীদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা অপরাধ করতে সাহস না পায়। পরিবার ও সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সন্তানের আচরণ, বন্ধুবান্ধব, চলাফেরা সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। সন্তান যেন বিপথে না যায়, সে বিষয়ে আগেভাগেই সতর্ক হতে হবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল থেকে
প্যানেল