ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ভারতীয় বাহিনী যখন লাহোর দখল করতে গিয়েছিলো: ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৮ মে ২০২৫

ভারতীয় বাহিনী যখন লাহোর দখল করতে গিয়েছিলো: ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায়

ছবি: প্রতীকী

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংকবহর পাকিস্তানের ওয়াঘা সীমান্ত অতিক্রম করে লাহোরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোর ছিল ভারতীয় সেনাদের প্রধান লক্ষ্য, আর এ নিয়েই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

এই যুদ্ধের শুরু এক মাস আগেই। ১৯৬৫ সালের আগস্টে পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রালটার’ নামের একটি গোপন সামরিক অভিযান চালায়। পাকিস্তানের ধারণা ছিল, কাশ্মীরিরা ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে এবং ভারত রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হবে।

কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত এই পরিকল্পনা জানতে পারে এবং পাল্টা সামরিক অভিযান চালায়, ফলে ব্যর্থ হয় ‘অপারেশন জিব্রালটার’।

এরপর অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম

১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান আবারও কাশ্মীরের আখনুর এলাকায় বড় ধরনের হামলা চালায়, যাকে ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ বলা হয়। এর লক্ষ্য ছিল ভারতের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আশা করেছিলেন আখনুর দখল করলেই ভারত আলোচনার টেবিলে বসবে।

কিন্তু ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল দৃঢ় ও কৌশলী। প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর নির্দেশে ভারত আক্রমণ সরাসরি কাশ্মীর সীমান্তে সীমাবদ্ধ না রেখে পাঞ্জাব ফ্রন্টে ছড়িয়ে দেয়। এতে পাকিস্তান বাধ্য হয় আখনুর থেকে সেনা সরিয়ে পাঞ্জাবের প্রতিরক্ষায় মোতায়েন করতে, ব্যর্থ হয় অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম।

লাহোরের উদ্দেশ্যে ভারতীয় অভিযান

৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং লাহোরের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতীয় সেনাপ্রধান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আগামীকাল সকালের চা খাব লাহোরে’। ভারতীয় বাহিনী লাহোর বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছেও যায়।

কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লাহোরের আশেপাশে খালের ওপর নির্মিত প্রায় ৭০টি সেতু ধ্বংস করে দিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে আটকে দেওয়া হয়।

খেমকারান ফ্রন্ট ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

ভারতের লাহোর অভিযানের জবাবে পাকিস্তান খেমকারানে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা। তৎকালীন মেজর (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৪৬৬ জনের একটি ইউনিট লাহোর রক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সাহসিকতার জন্য মেজর জিয়াউর রহমান ‘হিলাল-ই-জুররাত’ পদক লাভ করেন এবং তাঁর ইউনিটটি আরও তিনটি ‘সিতারা-ই-জুররাত’ এবং নয়টি ‘তমঘা-ই-জুররাত’ অর্জন করে।

যুদ্ধের বিস্তার ও পরিণতি

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চেয়েছিলেন যুদ্ধ শুধু কাশ্মীর সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকুক, কিন্তু বাস্তবে তা ছড়িয়ে পড়ে শিয়ালকোট, লাহোর, পাঞ্জাবসহ নানা ফ্রন্টে। এতে পাকিস্তান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রসদ সরবরাহে সংকট দেখা দেয়।

আরও বড় ধাক্কা আসে দুটি দিক থেকে—যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বদলে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ে, আর ভারত যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু কাশ্মীর থেকে সরিয়ে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যায়, যেখানে পাকিস্তানের অবকাঠামো ও সম্পদ ধ্বংস হতে থাকে।

যুদ্ধবিরতি ও তাসখন্দ চুক্তি

২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের আহ্বানে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। পরে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে উজবেকিস্তানের তাসখন্দে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন।

এই যুদ্ধ সাহসিকতা, রণকৌশল ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এক মিশ্র দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। কাশ্মীর ইস্যু থেকে সূচিত এই সংঘাত আজও অনিশ্চয়তার কুয়াশায় ঢাকা। আর তাই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একটি ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ শুধু ভূখণ্ড নয়, ইতিহাসের রূপও বদলে দিতে পারে।

 

সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=LtfxMNaoc3k

রাকিব

×