ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

নিরাপত্তাহীন নগরজীবন ও ছিনতাইয়ের ছায়া

আনিকা ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ১১ মে ২০২৫

নিরাপত্তাহীন নগরজীবন ও ছিনতাইয়ের ছায়া

শহর যত আধুনিক হয়, নাগরিকের চাওয়া তত বাড়ে। পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কিংবা বিনোদন সবকিছুতেই উন্নতির ছোঁয়া চায় মানুষ। কিন্তু এসব চাহিদার ঊর্ধ্বে থেকে যায় একটি মৌলিক প্রশ্ন- নিরাপত্তা কোথায়? যখন একজন নাগরিক নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিশ্চিন্তে ফিরতে পারে না, তখন প্রশ্ন উঠে এ শহরের উন্নয়নের মূল্য কী?
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে ছিনতাই একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। এটি শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু অপরাধ নয়; বরং একটি সংগঠিত, পরিকল্পিত এবং দিনের পর দিন বেড়ে চলা অপরাধপ্রবণতার নাম। ছিনতাইয়ের শিকার মানুষ শুধু অর্থ হারান না, হারান মানসিক শান্তি, অনেক সময় প্রাণও।
সন্ধ্যা নামলেই রাজধানীর অনেক এলাকায় যেন এক অদৃশ্য ভয় নেমে আসে। ব্যস্ত শহরের রাস্তাঘাট তখন শিকার খোঁজা হায়েনার মতো ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায়। শহরের নাগরিকরা অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় তাকিয়ে থাকেন কখন পেছন থেকে কে যেন হানা দেয়! এই আতঙ্ক এখন বাস্তবতা, শুধুই কল্পনা নয়।
ছিনতাই শুধু একক কোনো অপরাধ নয়, এটি নাগরিক জীবনের নিরাপত্তাকে ভেঙে দেয় একেবারে ভিত্তি থেকে। পকেটমার, ব্লেড মার, মলম পার্টি কিংবা মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারী- সবই যেন একই নাটকের বিভিন্ন চরিত্র। বিশেষ করে রাতের বেলা বা ফাঁকা রাস্তায় এসব ঘটনা ঘটে বেশি। তবে দিনদুপুরেও যে তারা থেমে থাকে না, তা প্রমাণ হয়েছে অসংখ্য ঘটনার মাধ্যমে।
অনেক সময় এসব অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, বরং শারীরিক আঘাত বা প্রাণও হারান। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া সংবাদ বলছে, ছিনতাইকারীদের হাতে ছুরি, চাকু, এমনকি অস্ত্র পর্যন্ত থাকে। অনেকে প্রতিরোধ করতে গেলে গুরুতর জখম হন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন আসে, কোথায় নিরাপত্তা?
পুলিশ প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা বেশির ভাগ সময়েই তাৎক্ষণিক ও বিচ্ছিন্ন। অনেক ভুক্তভোগী থানায় গিয়েও অভিযোগ করতে চান না- মামলা-জটিলতা, হয়রানি আর তেমন কোনো ফল না পাওয়ার আশঙ্কায়। ফলে অপরাধীরা আরও সাহস পায়, ছিনতাই হয়ে ওঠে তাদের নিয়মিত পেশা।
এই বাস্তবতা আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তার স্থান কোথায়? আমরা কি সত্যিই একটি বাসযোগ্য শহর গড়তে পেরেছি। নাকি শুধু ইট-পাথরের শহর বানিয়েছি, যেখানে মানুষ খাঁচাবন্দি পাখির মতো?
সমাধান সহজ নয়, তবে অসম্ভবও নয়। ছিনতাইয়ের পেছনে রয়েছে নানা কারণ- দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি এবং সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের সক্রিয়তা। এ পরিস্থিতিতে কেবল পুলিশি টহল দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন পরিকল্পিত শহর ব্যবস্থাপনা, সিসিটিভির বিস্তার, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি এবং অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে বিশেষ নজরদারি।
অন্যদিকে, নাগরিকদেরও হতে হবে সচেতন। নিজ নিজ এলাকায় পাহারাদার গোষ্ঠী গঠন, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় এবং দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান এসব উদ্যোগে ছিনতাই রোধে সহায়তা মিলতে পারে।
আমরা মনে করি, নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এটি নিশ্চিত না হলে নাগরিক জীবনে উন্নয়ন অর্থহীন। তাই ছিনতাইকে শুধু ‘ছোটখাটো অপরাধ’ হিসেবে দেখার দিন শেষ। এটি এখন একটি বড় সামাজিক সমস্যা, যা প্রতিরোধে দরকার রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার এবং সামগ্রিক সহযোগিতা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

প্যানেল

×