ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

ছিনতাই নৈরাজ্য বন্ধ করা হোক

ড. মো.শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১১ মে ২০২৫

ছিনতাই নৈরাজ্য বন্ধ করা হোক

বর্ধিত নজরদারি এবং বিশেষ অভিযানের মধ্যেও ঢাকার রাস্তায় বেড়েছে ছিনতাইকারী আতঙ্ক। সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। পুলিশ সদর দপ্তরের ক্রাইম ডাটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সারাদেশে মোট ১৫৯টি ‘ডাকাতি’ মামলা করা হয়েছিল, যা নভেম্বরে ছিল ১৩৩টি। ২০২৪ সালে এ মামলার সংখ্যা আগের বছরের ১ হাজার ২২৭টি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪১২টিতে দাঁড়িয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে রাজধানী এবং এর উপকণ্ঠে ৪৩২টি ছিনতাইয়ের জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই স্থানগুলোতে কমপক্ষে ৯৭৯ জন ছিনতাইকারী সক্রিয় আছে।
রাজধানীতে ঘোষণা দিয়ে ছিনতাইবিরোধী কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এটা ভালো উদ্যোগ। পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। এরকম কার্যক্রম চলমান থাকুক এটা আমাদের সাধারণ নাগরিকের প্রত্যাশা। কারণ আমরা নানা সময় ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ি। কোনো উপায় থাকে না। অনেক মূল্যবান এবং আকর্ষণীয় জিনিস তাদেরকে দিয়ে আসতে হয়। এমনকি ছিনতাইকারীর হাতে জীবন দিতে হয়। এসব দুর্ঘটনা খুবই দুঃখজনক।
সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই-আতঙ্ক নিয়ে চলতে হয় যাত্রী ও নগরবাসীর। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ভয়ংকর তৎপর হয়ে উঠছে ছিনতাইকারীরা। অর্থ ও মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নৃশংস আঘাতে প্রাণও যাচ্ছে অনেকের। কলেজছাত্র সাইদ রাকিব, যিনি ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই খুন হন। অকালে দেশ হারিয়ে ফেলল এক মেধাবী ছাত্র এবং পরিবার হারাল তাদের স্বপ্নকে। যে স্বপ্ন একদিন পরিবারের হাল ধরত। এসব মেনে নেওয়া যায় না। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, পুলিশের চলমান অভিযানের মধ্যেই একটি ছাত্রের মৃত্যু হলো। ফলে বর্তমানে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে চলছে। ঢাকায় অনেক অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাতে অফিস করতে হয়। যাদের মধ্যে বিশেষ করে সাংবাদিক অনেক রাতে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকের ছিনতাইকারীদের হাতে ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে দেখতে পাই। তাদের জন্য ছিনতাই বিষয়টি আরও আতঙ্কের। অনেক যাত্রী বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আসে নানা কাজে যেমন চিকিৎসা, অফিস এবং চাকরির সন্ধানে। তাদের আসতে অনেকের গভীর রাত হয় এবং অনেকের খুব সকাল। যখনই তারা গাড়ি বা ট্রেন থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়, তখনই তারা ছিনতাইকারীর হাতে ধরা পড়ে। এজন্য বাসের কাউন্টার সংলগ্ন টহল বৃদ্ধির পাশাপাশি সকল কাউন্টার ২৪ ঘণ্টা খোলা বা সকাল পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি তদারকি বাড়াতে হবে। যাতে দূরপাল্লার যাত্রীরা সকাল হওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ কাউন্টারে অপেক্ষা করতে পারেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান (২০২৩) অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেই ছিনতাই, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে ছয় হাজারের বেশি মানুষ জড়িত। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাই এবং ৪ হাজার ৪৬১ জন ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। রমনা, গুলশান, মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিল, ওয়ারী ও লালবাগ, তেজগাঁও এলাকায় ছিনতাই ও অনুরূপ অপরাধে জড়িতদের সংখ্যা বেশি। এখন শুধু ঢাকায় ছিনতাই হয় তা নয়, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ঘটে থাকে। ময়মনসিংহ শহরে গাঙ্গিনারপার, চরপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই হয়ে থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০২৪ সালের তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ৮১০ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তালিকায় উঠে এসেছে মোহাম্মদপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তালিকা অনুসারে, মোহাম্মদপুর থানার আওতাধীন এলাকায় ২০৫ জন ছিনতাইয়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি ১০৮টি ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে। এখানে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় রাস্তার মোড়, স্টেশনে বা ফুটব্রিজের নিচে যানজটে আটকা পড়ে অনেক বাস। হঠাৎ বাসের জানালা দিয়ে ছিনতাইকারী যাত্রীদের হাতে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং অনেকের নিয়ে যায়, যা আমাদের চোখে অনেক সময় দেখতে পাই।
ক্রমবর্ধমান আর্থিক ভোগান্তি, বেকারত্ব, যুবকদের মধ্যে হতাশা- এসব কারণে ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মাদক।  এসব কারণে অনেক যুবক অপরাধের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান সমাজে ছিনতাইয়ের বৃদ্ধি ইঙ্গিত করে যে এ ধরনের মাদক সেবনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার নির্দিষ্ট এলাকায় অনেক পথশিশু ও তরুণ-তরুণীকে মাদক সেবন করতে দেখা যায়। সরকারকে এ ধরনের ব্যক্তির জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে যাতে তারা পরিষ্কার এবং মাদকমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে। চাকরির পাশাপাশি তাদের জন্য একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা নিশ্চিত করবে যে তারা অপরাধের জগতে প্রবেশ করবে না। সমাজে মাদক বন্ধ করতে হবে চিরতরে। মাদক বন্ধ হলে ছিনতাই অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশই মাদকাসক্ত। মাদক বন্ধে সরকারের নানামুখী ব্যতিক্রমী জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু করতে হবে। আর যেগুলো চালু রয়েছে, সেগুলোর কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। ছিনতাইকারীদের ধরতে নিরাপত্তা অভিযানের পাশাপাশি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ নিলেই ঢাকার রাস্তা নিরাপদ করা যেতে পারে। রাস্তায় বিদ্যুৎ অনেক সময় চলে যায়, যা ছিনতাই বাড়িয়ে দেয়। তাই রাস্তায় বিদ্যমান লাইটের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে রাস্তা সঠিকভাবে আলোকিত করতে হবে। সর্বদা বিদ্যুৎ চলমান রাখতে হবে। পুলিশকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং চিহ্নিত এলাকায় বিশেষ করে লোডশেডিংয়ের সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এমন এলাকায় নিয়মিত টহল চালাতে হবে। ছিনতাইকারীদের ধরার পাশাপাশি ছিনতাইকারী চক্রের নেতাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
পুলিশের তালিকাভুক্ত ও গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারীদের অধিকাংশের বয়স ২০-৩০ বছর। পুরনো পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি ছিনতাইয়ে প্রতিদিন নতুন মুখ বাড়ছে। নতুন ছিনতাইকারীর সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সেজন্য আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু সরকার দায়িত্ব নিবে, বিষয়টি এরকম না। আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারের ছেলেমেয়ে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে এসব লক্ষ্য রাখতে হবে। এখন অনেক তরুণ সমাজ মাদকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যখন তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখন মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ছিনতাই করতে উৎসাহী হয়ে পড়ে। ভয়াবহ অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। এমনকি মাদকের কারণে পিতা-মাতাকে হত্যা করতে ভয় পায় না। তাই এসব বন্ধ করার জন্য সমাজের জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক, নাগরিক সমাজ এবং শিক্ষকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে।  
এসব ছিনতাইকারী রাজধানীতে তিন ধাপে ভাগ হয়ে ছিনতাই করছে। এর মধ্যে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীরা বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। তাই তিন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি বাড়াত হবে। ইউনিফর্ম এবং সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে তাদের কঠোর নজরদারির অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন স্থানে মনিটরিং বাড়াতে হবে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্ধিতসংখ্যক চেকপোস্ট বসানো একান্ত জরুরি। আমাদের সমাজে সমালোচনা রয়েছে যে ছিনতাইকারী যখন ধরা পড়ে, তাদের অনেকেরই বিচার হয় না। তাই প্রশ্ন জাগে যখন ধরা পড়ে, প্রকৃতপক্ষে এসব অপরাধী বিচারের মুখোমুখি হয়, নাকি তারা আইনি ব্যবস্থায় অর্থ প্রদান বা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। যদি তারা তাদের প্রাপ্য শাস্তি পায়, তাহলে ছিনতাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। আর যদি তা না হয়,তাহলে তারা তাদের অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহসী বোধ করবে এবং এ ধরনের আরও ব্যক্তি “পেশা” হিসেবে এই কাজে যোগদান করবে, যা খুবই নিন্দনীয়।
রাস্তাগুলো যাতে নিরাপদ থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য, সরকারকে সেই কারণগুলো মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে তরুণদের মাদক গ্রহণ বন্ধ হয় এবং অন্যান্য অপরাধ প্রথা যেন কমে যায়। নিষিদ্ধ মাদক বিশেষ করে ইয়াবার ব্যবহার দেশে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ছিনতাই ও চুরির মতো অনেক অপরাধমূলক কাজের সূত্রপাত করছে। দীর্ঘদিন ‘ইয়াবা’ সেবনে শারীরিক ও মানসিক মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। এর মরণ ছোবলে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই ইয়াবার কারবার বন্ধ করতে হবে। যারা ইয়াবার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোর আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করাতে হবে।  

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

প্যানেল

×