
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, যা দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রেখেছে। তার ইংরেজি নাম ‘চিটাগং’ (Chittagong) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল। প্রায় এক হাজার বছরের পুরানো এই নগরীর বন্দর হয়ে ইউরোপীয় বণিক, চীনা পর্যটক ও বিভিন্ন শাসকের আগমন ঘটেছে, যারা নিজেদের ভাষায় শহরটিকে ‘চিটাগং’ নামে উল্লেখ করতেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার শহরটির ইংরেজি নাম পরিবর্তন করে ‘চট্টগ্রাম’ রাখে, যা বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও এ সিদ্ধান্তটি জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়, অনেকের মতে, ‘চিটাগং’ নামটিকেও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে ধরে রাখা যেত। এতে করে ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক পরিচিতির মাঝে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হতো। কারণ ‘চিটাগং’ শুধু একটি নাম নয়, এটি বহির্বিশ্বে আমাদের বন্দরনগরীর পরিচয় ও শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাসের প্রতীক।
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ শহর, যা প্রাচীনকাল থেকেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চিনা পর্যটক, আরব ও ইউরোপীয় বণিকদের আগমন এই শহরকে বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিত করে তোলে। ইতিহাসবিদদের মতে, চিটাগং নামটির পেছনে আরব বণিক ও আরাকানিদের প্রভাব রয়েছে। তবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকেই Chittagong নামটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং শহরটির ঐতিহাসিক পরিচয়ের অংশে পরিণত হয়।
চিটাগং শুধু একটি শব্দ নয়, এটি শহরের আন্তর্জাতিক পরিচয় ও শতাব্দীজুড়ে গঠিত ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে। ইউরোপীয় মানচিত্র, সরকারি দলিল এবং উপনিবেশিক সাহিত্য- সবখানেই এই নামটির ব্যবহার প্রমাণ করে যে এটি কেবল স্থাননাম নয়, বরং স্মৃতি ও যোগাযোগের ধারক। এমনকি আজও বাংলাভাষী মানুষ দৈনন্দিন কথোপকথনে চট্টগ্রাম বললেও, ইংরেজিতে লিখতে বা বলতে গেলে ‘চিটাগং’-এর প্রতিই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।
২০১৮ সালে হঠাৎ করে সরকারিভাবে ‘Chittagong’ নামটি পরিবর্তন করে Chattogram রাখা হয়, যা বাংলার ধ্বনিগত মিল রক্ষার জন্য করা হয়েছে। যদিও এই পরিবর্তন সংস্কৃতি ও ভাষার মর্যাদা রক্ষার একটি প্রচেষ্টা, তবুও অনেকের মতে এতে শহরের আন্তর্জাতিক পরিচিতিতে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। বহির্বিশ্বে বহু মানুষ এখনো ‘চিটাগং’ নামেই শহরটিকে চেনে এবং নতুন নামটি তাঁদের কাছে অপরিচিত থেকে যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো গণশুনানি, জনমত সংগ্রহ বা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা প্রশ্ন তুলেছে এর গ্রহণযোগ্যতা ও যুক্তিসংগততা নিয়ে।
একটি শহরের নাম শুধু প্রশাসনিক পরিচয় নয়, এটি ঐতিহাসিক স্মৃতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক সংযোগের ধারক। অতএব, চিটাগং নামটি পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার দাবি শুধুই আবেগের নয়, এটি ঐতিহ্য সংরক্ষণের দাবিও বটে। সময় এসেছে এই সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার, যাতে ইতিহাস, পরিচিতি ও জাতীয় গৌরব সবকিছুই সঠিকভাবে সংরক্ষিত থাকে।
২০১৮ সালে সরকার চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার ইংরেজি নাম বাংলার উচ্চারণ অনুযায়ী রূপান্তর করে। এর অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের দীর্ঘকালীন ইংরেজি নাম ‘Chittagong’ পরিবর্তন করে ‘Chattogram’ নির্ধারণ করা হয়। যদিও এ সিদ্ধান্ত ভাষাগত সংগতি রক্ষার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে উপস্থাপিত হয়, তবে এর পেছনে সুস্পষ্ট যুক্তি বা গবেষণালব্ধ ব্যাখ্যা অনেকাংশেই অনুপস্থিত ছিল, যা আজও বিতর্ক ও সংশয়ের জন্ম দেয়।
চিটাগং নামটি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চট্টগ্রামের পরিচয় বহন করে আসছে। ইউরোপীয় নথিপত্র, প্রাচীন মানচিত্র এবং উপনিবেশিক ইতিহাসে এই নামটির বহুল ব্যবহার শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও গ্লোবাল অবস্থানকে তুলে ধরে। ফলে হঠাৎ করে এই নাম পরিবর্তন অনেকের কাছে ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নতার এক প্রতীক বলেই প্রতিভাত হয়েছে। বিদেশী ব্যবসায়ী, পর্যটক কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য ‘Chattogram’ একটি অপরিচিত ও বিভ্রান্তিকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ইংরেজি ভাষায় কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের নাম দেশীয় উচ্চারণ অনুযায়ী পরিবর্তন করার বাধ্যবাধকতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, ইন্ডিয়া দেশীয়ভাবে ‘ভারত’ এবং জাপান দেশীয়ভাবে নিহোন (Nihon) বা নিপ্পন (Nippon) হলেও, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা ইংরেজি নামেই পরিচিত। একইভাবে চিটাগং নামটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিকভাবে সহজে চেনা যায়, যা বাণিজ্য, পর্যটন ও কূটনৈতিক যোগাযোগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিটাগং কেবল একটি নাম নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক পরিচিতি, যা শহরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততাকে বহন করে। যদিও ‘Chattogram’ নামটি স্থানীয় উচ্চারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক পরিসরে এটি শহরটির প্রতিষ্ঠিত পরিচিতিতে একটি বিভ্রান্তি ও ছেদ তৈরি করতে পারে। বাস্তবতাও বলছে, বেশিরভাগ বাংলাদেশী এখনো ইংরেজীতে ‘Chittagong’ নাম ব্যবহারে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুতরাং, ‘চিটাগং’ নামটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হলে তা ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। একটি শহরের নাম শুধুই শব্দের পরিবর্তন নয়; বরং তা ইতিহাস, স্মৃতি এবং গৌরবের ধারক। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়।
২০১৮ সালে, সরকার ‘Chittagong’ নাম পরিবর্তন করে ‘Chattogram’ রূপ গ্রহণ করে। যদিও এটি বাংলার উচ্চারণের কাছাকাছি, পরিবর্তনের ফলে শহরটির ঐতিহ্যগত আন্তর্জাতিক পরিচয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অনেকের কাছে এই পরিবর্তন অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক মনে হয়েছে। সাধারণভাবে কোনো শহরের নাম পরিবর্তন তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তা সমাজের কাছে আপত্তিকর বা অবমাননাকর কোনো অর্থ বহন করে। ‘চিটাগং’ নামটির ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রেক্ষাপট নেই। বরং এটি শহরের একটি সম্মানিত ঐতিহাসিক পরিচয়, যা স্থানীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলে সমানভাবে গৌরবের বিষয়।
চিটাগং নামে শহরটি যখন বিশ্বে পরিচিত ছিল, তখন এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও সাংস্কৃতিক সংযোগ আরও সুদৃঢ় ছিল। অতএব, এই ঐতিহাসিক নাম সংরক্ষণ মানে দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং বৈশ্বিকভাবে একটি সুপরিচিত পরিচয় বজায় রাখা।
নামকরণের রাজনীতি কোনো দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক সময় এমন পরিবর্তনগুলো ইতিহাসের প্রতি অবিচার হিসেবেও বিবেচিত হয়। ‘Chittagong’ থেকে ‘Chattogram’-এ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি অনেকের কাছে একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ বলে মনে হয়েছে, যেখানে জাতীয় পরিচয়ের এককীকরণ প্রাধান্য পেয়েছে অযৌক্তিকভাবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও ঐতিহ্য উপেক্ষিত হয়েছে।
বহু শতাব্দী ধরে চিটাগং নামে শহরটি ইউরোপীয় বণিক, চীনা পর্যটক ও বৈদেশিক ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত ছিল। এই নাম শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি বন্দরনগরীর গৌরবময় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। আকস্মিকভাবে নাম পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও মানচিত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তাই রাজনৈতিক প্রভাব এড়িয়ে নামকরণে ঐতিহ্য ও বাস্তবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চিটাগং নামের পুনঃপ্রবর্তন সম্পূর্ণ যৌক্তিক। শতবর্ষের পুরানো একটি নাম পাঁচ বছরের ব্যবধানে এতটাই অচল হয়ে যায়নি যে, তা মুছে ফেলার প্রয়োজন পড়বে। বাস্তবে এখনো অধিকাংশ মানুষ ইংরেজিতে চিটাগং নামটিই ব্যবহার করেন। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এখনো পূর্বনাম ব্যবহার করে চলেছে। এই নামটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চিটাগং নাম ফিরিয়ে আনলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হবে, যা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারের উচিত এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা এবং জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
চট্টগ্রাম শুধু একটি বন্দরনগরী নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও গৌরবের প্রতীক। চিটাগং নামটি পুনঃপ্রবর্তন করা মানে সেই গৌরব পুনরুদ্ধার করা, যা কেবল চট্টগ্রামবাসীর নয়, বরং সমগ্র জাতির অহংকার। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে যথাযথ সম্মান জানাতে হলে, এমন ঐতিহাসিক নামগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি। যেহেতু ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্থান তাদের পূর্বনাম ফিরে পেয়েছে, বা নাম পরিবর্তন ঘটেছে, সেহেতু চিটাগং নামটিও পূর্বরূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব এবং প্রাসঙ্গিক।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল