ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

যুদ্ধ কখনই শান্তির বিকল্প নয়

মীর আব্দুল আলীম

প্রকাশিত: ২০:২১, ১১ মে ২০২৫

যুদ্ধ কখনই শান্তির বিকল্প নয়

কাশ্মীরের পেহেলগামের বুকে যখন আত্মঘাতী হামলায় ২৬টি প্রাণ একসঙ্গে নিভে যায়, তখন উপমহাদেশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এমন হামলা ভারতকে আবার ভাবতে বাধ্য করে- তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত। ইতিহাসের পাতায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক মানেই যেন দ্বন্দ্ব, সংঘাত যুদ্ধ আর অবিশ্বাসের কাহিনী। প্রতিশোধ নিতে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তানও।
১৯৪৭-এর রক্তাক্ত বিভাজনের পর থেকে শুরু হওয়া এই তিক্ত সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীতেও স্থির হয়নি। আবারও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। সীমান্তে ট্যাংক, রণতরী, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত। দুদেশের মিডিয়া হেডলাইন করছে ‘যুদ্ধ অনিবার্য’। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই যুদ্ধ কার জন্য, কাদের জন্য? ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ মানেই হাজারো প্রাণহানি, সীমান্তে উদ্বাস্তু, অর্থনীতিতে ধস এবং মানবিক বিপর্যয়। ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯-এই তিনটি বড় যুদ্ধ দেখেছে এই উপমহাদেশ। প্রতিটি যুদ্ধে প্রাণ গেছে সাধারণ মানুষের। রাষ্ট্রযন্ত্রের জয়-পরাজয় যেটাই হোক, হার হয় মানবতার। কারগিলের বরফে জমে থাকা সৈনিকের লাশ হোক কিংবা লাহোরের হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়া কোনো মা-যুদ্ধের অভিঘাত কখনো একতরফা থাকে না। এই ইতিহাস জানা সত্ত্বেও কেন আমরা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করি? কেন কূটনৈতিক সংলাপের বিকল্প হিসেবে অস্ত্র তুলে নিই? ভুলে যাই যে এটা শান্তির পথ নয়।
যুদ্ধের দামামা যতই বেজে উঠুক না কেন, শান্তির পথ কখনো বন্ধ হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসই বলে, অস্ত্রের ঝনঝনানি কখনো দীর্ঘদিন আলোয় পথ দেখাতে পারে না; শেষ পর্যন্ত আলো আসে আলোচনার টেবিল থেকে। এই মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের দরকার এমন এক ‘বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব’, যারা রাজনৈতিক ফায়দার চেয়ে মানবিকতা ও জনগণের কল্যাণকে বড় করে দেখবে। যারা অস্ত্রের নয়, আলোচনার শক্তিকে গুরুত্ব দেবে। যারা জানে, মানুষের চোখের জল দিয়ে কোনো রাষ্ট্র গড়া যায় না- তা গড়া যায় সাহস, সহমর্মিতা আর শান্তির স্থাপত্যে।
যুদ্ধের জয় নেই, কেবল মৃত্যু আছে। প্রশ্ন উঠছে- এই যুদ্ধ কাদের জন্য? রাজনীতিকদের মুখর ভাষণ আর অস্ত্র প্রস্তুত থাকার খবরে জনতা বিভ্রান্ত। অথচ পুড়বে সীমান্তের ঘর, কাঁদবে বাবা-মা, শহর দেখবে মৃতদেহে মোড়া তরুণদের কফিন। বলতে হয়-‘যুদ্ধ তো দুই দেশের নেতারা চালায়, কিন্তু মরতে হয় দুই দেশের মানুষকেই।’ দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ নেতারা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তার ওপর। যুদ্ধ নয়, সংলাপ হোক। গর্জে ওঠা যুদ্ধবিমান থেমে যাক। তার বদলে শুরু হোক টেবিল টক। বন্ধ হোক যুদ্ধের শোরগোল, শুরু হোক শান্তির পদধ্বনি।
অনেকেই মনে করেন শান্তি একটি দুর্বলতা, একটি আপোসের নাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, শান্তি রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে বেশি সাহস লাগে। ভারত-পাকিস্তানের নেতৃত্বকে সেই সাহস দেখাতে হবে। কূটনৈতিক সংলাপ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে দুই দেশ একে অপরের প্রতি আস্থা গড়ে তুলতে পারে। আজকের বৈশ্বিক বিশ্বায়নের যুগে, যুদ্ধ কোনো দেশকেই দীর্ঘমেয়াদে লাভ দিতে পারে না। বরং সংলাপ, সহযোগিতা, আন্তরিকতা-এসবের মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে এক নতুন উপমহাদেশ।
কাশ্মীর থেকে সিন্ধু, দিল্লি থেকে ইসলামাবাদ-সব জায়গায় এখন একটাই বার্তা পৌঁছানো জরুরি : যুদ্ধ নয়, বন্ধুত্ব চাই। হিংসা নয়, হৃদ্যতা চাই। রণনীতি নয়, রেনেসাঁ চাই। আমাদের দরকার এমন এক উপমহাদেশ, যেখানে কাঁটাতার নয়, থাকবে কাঁটাচামচে একসঙ্গে খাওয়া। যেখানে পাসপোর্ট নয়, হৃদয়ের ভিসায় মানুষ মানুষের কাছে যাবে। যেখানে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ নয়, স্কুলের মাঠে একসঙ্গে খেলে বেড়াবে দুই দেশের শিশু। শান্তির ডাক কখনো দুর্বলতার ভাষা নয়, বরং এটি সাহসীদের উচ্চারণ যারা জানে, মানুষের জীবনই সর্বোচ্চ মূল্যবান সম্পদ। যুদ্ধ যে শুধু সৈনিকই খায় না, তা খেয়ে ফেলে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে, পুড়িয়ে দেয় আগামী প্রজন্মের স্বপ্নগুলোকে। দুই দেশের সাংবাদিক, কবি, লেখক, শিল্পী, চিকিৎসক, তরুণ সমাজ-সবারই একযোগে বলা দরকার: যুদ্ধ থামাও, আলো জ্বালাও।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে প্রতিবারই দুই দেশের সম্পর্ক চরমে পৌঁছায়। ভারত কাশ্মীরকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখে। অথচ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটিকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু’ হিসেবে উপস্থাপন করে। মাঝখানে পড়ে থাকে উপত্যকার বাসিন্দারা-যারা বছরের পর বছর ধরে সহ্য করে যাচ্ছে দমন-পীড়ন, বুলেট, কারফিউ আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কাশ্মীরিদের চোখে ভয়, কানে গুলির শব্দ, আর মুখে প্রশ্ন-‘আমাদের অপরাধ কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে দিল্লিকে, দিতে হবে ইসলামাবাদকেও। এখানে যুদ্ধ কখনোই সমাধান হতে পারে না। বরং দীর্ঘমেয়াদি, সৎ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাভিত্তিক সংলাপই হতে পারে একমাত্র পথ।
১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি একটি যুগান্তকারী চুক্তি ছিল-যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও প্রশংসা করেছিল ভারত ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক পরিপক্বতাকে। আজ যদি ভারত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই চুক্তি স্থগিত করে, তাহলে সেটি কেবল একটি চুক্তি লঙ্ঘন নয়, বরং যুদ্ধের প্রক্সি রূপ হিসেবে বিবেচিত হবে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে একে ‘পানিযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছে। একটি নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করা মানে শুধু কৃষির মৃত্যু নয়, পুরো জনজীবনের ওপর একপ্রকার নিঃশব্দ যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া। এমন সিদ্ধান্ত কেবল উত্তেজনা বাড়াবে, শান্তি নয়। পানিকে যদি অস্ত্র বানানো হয়, তবে সেটা শুধু পাকিস্তানের নয়, উপমহাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করবে। এ বিষয়টি ভাবতে হবে ভারতকে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইসরাইলের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন উপমহাদেশীয় ভূরাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক সামরিক, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে দীর্ঘদিনের। এই সম্পর্ক এখন যদি যুদ্ধক্ষেত্রেও রূপ পায়, তবে পাকিস্তানও তার পক্ষশক্তি হিসেবে চীন, তুরস্ক এমনকি সৌদি আরবকে পাশে দাঁড় করাতে চাইবে। ফলে, আঞ্চলিক সংঘাত খুব সহজেই আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে। যার প্রভাব শুধু ভারত-পাকিস্তান সীমাবদ্ধ থাকবে না-প্রভাব পড়বে আফগানিস্তান, ইরান, বাংলাদেশ, এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওপরও।
যখন সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়ানো হয়, তখন আমরা যারা কলাম লিখি তাদের কি করা উচিত। চিন্তকের ভূমিকায় থাকা শ্রেয় নিশ্চয়। সাংবাদিকদের কলমে থাকতে হয় মনুষ্যত্বের জোর। আমরা মনে করি ‘যুদ্ধ কোনো দেশকে জয় এনে দেয় না, শুধু শোক এনে দেয়।’ আজকের এই সময়ে আমাদের কলমযোদ্ধারা, যারা যুদ্ধের হুঙ্কার নয়- শান্তির পক্ষে উচ্চারণ করবেন। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি শান্তি চায়, সেই জাতি দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি লাভ করে। গণমাধ্যমের বড় দায়িত্ব হলো জনমত গঠন করা। সেই দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকরা যদি শুধুই রেটিং বা চটকদার হেডলাইনের পেছনে ছোটেন, তাহলে তারা আর সাংবাদিক নন- তারা যুদ্ধ উসকে দেওয়া একপ্রকার প্রচারযন্ত্র। সত্য সাংবাদিকতা শান্তি চায়। কারণ সংবাদপত্র যুদ্ধের অস্ত্র নয়, বরং সমাজ বিবেকের দর্পণ।
আজ সময় এসেছে সাহসিকতার নতুন সংজ্ঞা গড়ার-যেখানে সীমান্তে গোলাগুলির নয়, হবে করমর্দনের প্রতিধ্বনি। সময় এসেছে বলার: ভালোবাসাই সর্বোচ্চ কূটনীতি। আজকের এই উত্তপ্ত সময়েই শুরু হোক নতুন অধ্যায়, যেখানে ইতিহাস নয়, ভবিষ্যৎ আমাদের পথ দেখাবে। শান্তি হোক রাষ্ট্রনীতির প্রথম শব্দ, আর ভালোবাসা হোক আমাদের যুগল স্বাক্ষর।
তবে আশার কথা এই যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে আপাতত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও ভারত। আজ এ বিষয়ে দিল্লি ইসলামাবাদের আলোচনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক

প্যানেল

×