ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

কৃষিশিক্ষার রূপান্তর

নেতৃত্ব উদ্যোগ ও টেকসই উন্নয়ন

ড. শাহরীনা আখতার

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১১ মে ২০২৫

নেতৃত্ব উদ্যোগ ও টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশের কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭,৫০০ স্নাতক উত্তীর্ণ হচ্ছে (ইউজিসি গ্র্যাজুয়েট ট্র্যাকিং রিপোর্ট, ২০২৪)। কৃষিতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৎস্য ও পশুপালন বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে তারা কর্মজীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারি খাতে, যেমন- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বারি, ব্রি ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১৮-২০ শতাংশ স্নাতক কর্মসংস্থান পাচ্ছে। বেসরকারি এগ্রোবিজনেস, কৃষি ইনপুট শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যুক্ত হচ্ছে ২৫-৩০ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বা গবেষণায় যাচ্ছে ১০-১২ শতাংশ। অথচ ৩৫-৪০ শতাংশ স্নাতক তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বেকার বা আংশিক বেকার অবস্থায় থাকে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২৩)। জাতীয় যুব বেকারত্ব যেখানে ১০.৬ শতাংশ, সেখানে কৃষি স্নাতকদের বেকারত্ব প্রায় দ্বিগুণ। এ চিত্র দেশের কৃষিশিক্ষা ও শ্রমবাজারের মাঝে একটি গভীর অমিলের এবং নীতিগত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
দক্ষতা বনাম বাজার বাস্তবতা : বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি পাঠক্রম মূলত প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। যেখানে ফসল উৎপাদন, মাটির পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, সেচ প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব কৃষিকৌশল শেখানো হলেও উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রায় অনুপস্থিত। যেমন- কোম্পানি গঠন, বাজার বিশ্লেষণ, বিনিয়োগ সংগ্রহ এবং ক্যাশ ফ্লো ব্যবস্থাপনা, এই বিষয়গুলোর প্রশিক্ষণ কৃষি শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। ফলে কৃষি স্নাতকদের বড় অংশ কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইউজিসি কারিকুলাম রিভিউ রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র ৫ শতাংশ কোর্সে উদ্যোক্তা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত। আইএফপিআরআই (২০২৩) এর গবেষণা অনুসারে, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষি স্নাতকদের মধ্যে ব্যবসা শুরুর সম্ভাবনা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই উদ্যোক্তা-শূন্য শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অধিকাংশ কৃষি স্নাতক চাকরির সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যেই আটকে থাকছে, যা কৃষির উন্নতির পথে বড় এক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
সুযোগের দোরগোড়ায় হারানো সম্ভাবনা : বাংলাদেশের কৃষিখাত প্রতি বছর গড়ে ৩.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও, সমগ্র এগ্রিবিজনেস খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ। উচ্চমূল্যের ফল-সবজি উৎপাদন, জৈব কৃষি, আধুনিক মৎস্যচাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষিপণ্য রপ্তানির বিশাল বাজার উদ্যোক্তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (Agri-SME) প্রসারের মাধ্যমে গ্রামীণ আয় বছরে ২-৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি সম্ভব। তবে উদ্যোক্তা দক্ষতার অভাবে অধিকাংশ কৃষি স্নাতক এখনো এসব উদীয়মান সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বাজারমুখী দক্ষতা গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের কৃষিশিক্ষা শুধু চাকরির জন্য নয়, উদ্যোক্তা তৈরির এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হতে পারে।
শিক্ষাক্রমে ‘অ্যাগ্রিপ্রেনারশিপ’ যুক্ত করার যুক্তি : বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায়, কৃষি পাঠক্রমে উদ্যোক্তা শিক্ষা যুক্ত করলে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ম্যানেজমেন্ট (Agri-SME) ২০১৯-২০ সালে ১১টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যোক্তা মডিউল চালু করে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের স্টার্টআপ গঠনের সম্ভাবনা ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পায় (FAO I World Bank, ২০২৩)। ভিয়েতনামে ‘অ্যাগ্রিকালচার ইনোভেশন প্রোগ্রাম’ চালুর পরে তিন বছরে কৃষিভিত্তিক ব্যবসা নিবন্ধন ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এখন সময় এসেছে কৃষি শিক্ষায় ধাপে ধাপে উদ্যোক্তা মডিউল সংযোজনের। এর জন্য ব্যবসা সচেতনতাবিষয়ক কোর্স চালু, বাজারভিত্তিক প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সাপোর্ট গড়ে তোলা এবং চূড়ান্ত বর্ষে এগ্রি-স্টার্টআপ প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
পথ বদলানোর ডাক :   FAO-এর বাংলাদেশ প্রতিবেদন (২০২৩) অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষির ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যা এবং লবণাক্ততা কৃষির উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, যা আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, ILO-এর গ্রীন জবস অ্যাসেসমেন্ট ২০২৪ রিপোর্টে বলা হয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে কৃষি খাতে প্রায় ৩০ লাখ পরিবেশবান্ধব (Green Jobs) কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। তবে এই কর্মক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশ করতে হলে আমাদের প্রয়োজন উদ্ভাবনী, অভিযোজনযোগ্য এবং উদ্যোক্তা মনস্ক কৃষি পেশাজীবী। যুবক ও কৃষি স্নাতকদের জন্য নতুন ব্যবসায়িক সুযোগের সৃজন এবং কৃষির প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। ইউজিসি সতর্ক করে বলছে, যদি কৃষি শিক্ষায় উদ্যোক্তা দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত না করা হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরে কৃষি স্নাতকদের বেকারত্ব আরও ৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এটি কৃষি উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নতির পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সাহসী পথচলার অনুপ্রেরণা : বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কিছু সাহসী উদ্যোগের সফলতা আমাদের অনুপ্রাণিত করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ‘Agroshift’ নামক একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকের পণ্য সরাসরি শহরের সুপারশপগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তারা ৫০টিরও বেশি সুপারশপে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। ‘কৃষক বন্ধু’ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মও কৃষকদের জন্য বিশেষ কার্যকর, যেটি এক লাখেরও বেশি কৃষককে পরামর্শ দিয়ে গড় আয় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। ‘ইকোক্রপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান জলবায়ু সহনশীল বীজ উৎপাদন করে নেপাল ও মিয়ানমারে রপ্তানি শুরু করেছে। এছাড়া, কৃষির অগ্রগতির জন্য নানান উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ, যা কৃষির সাস্টেইনেবিলিটি এবং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এইসব উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, যদি সঠিক সুযোগ তৈরি করা যায়, তবে তরুণ কৃষি স্নাতকরাই বাংলাদেশের কৃষি খাতকে পাল্টে দিতে সক্ষম। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং উদ্যোক্তা মনোভাব কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে।
আগামী কৃষি-সাহসী স্বপ্নের ঠিকানা : বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষায় পরিবর্তন এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। শুধু গবেষক বা সম্প্রসারণ কর্মী তৈরি করাই নয় বরং উদ্যোক্তা ও নেতৃত্ব বিকাশকারী প্রজন্ম তৈরি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা কেন্দ্র স্থাপন করা, স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবসায়িক অনুদান প্রকল্প চালু করা প্রয়োজন। কৃষি শিক্ষায় উদ্যোক্তা মনোভাবের বিকাশ কৃষির আধুনিকায়ন এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের সফলতা নিশ্চিত করতে পারে। এটি শুধু চাকরি পাওয়ার বিষয় নয়। একজন কৃষি শিক্ষার্থীর স্নাতক জীবন শেষ হওয়া উচিত একটি সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক চিন্তা, সম্ভাব্য গ্রাহক নেটওয়ার্ক এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে। উদ্যোক্তা হওয়া এখন আর বিকল্প নয় বরং এটি বাংলাদেশের কৃষির নবযাত্রার মূল চাবিকাঠি। দেশের কৃষি খাতকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে।
যেখানে ফসলের সঙ্গে বেড়ে ওঠে স্বপ্ন : আগামী দিনের কৃষি বিপ্লব আসবে প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তার যুগলবন্দিতে। পৃথিবীজুড়ে কৃষি খাত আধুনিকায়নে বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা মনোভাবের প্রয়োজন। বাংলাদেশেও এই পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের কৃষি শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যদি আজকের কৃষি শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের দক্ষতা এবং উদ্ভাবনের চেতনায় গড়ে ওঠেন, তবে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং গ্রামীণ উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হবো। আমাদের কৃষি খাত শুধু ফসল উৎপাদন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না বরং কৃষি উদ্যোক্তা, প্রযুক্তি উদ্ভাবক এবং নেতৃত্ব বিকাশে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই পরিবর্তন শুধু দেশের কৃষির জন্য নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে। স্বপ্ন কেবল ফসলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং আমাদের চিন্তা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কৃষি-নেতৃত্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য নতুন ধরনের ভাবনা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি খাতে নতুন যুগের সূচনা করতে হলে স্বপ্নের সঠিক পথ ধরে, একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব গঠন করতে হবে যা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে সামনে নিয়ে যাবে। শুধু ফসল নয়, গড়ে তুলতে হবে স্বপ্ন, চিন্তা এবং ভবিষ্যতের কৃষি-নেতৃত্ব।
লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশের কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭,৫০০ স্নাতক উত্তীর্ণ হচ্ছে (ইউজিসি গ্র্যাজুয়েট ট্র্যাকিং রিপোর্ট, ২০২৪)। কৃষিতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, কৃষি অর্থনীতি, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৎস্য ও পশুপালন বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে তারা কর্মজীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারি খাতে, যেমন- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বারি, ব্রি ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১৮-২০ শতাংশ স্নাতক কর্মসংস্থান পাচ্ছে। বেসরকারি এগ্রোবিজনেস, কৃষি ইনপুট শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যুক্ত হচ্ছে ২৫-৩০ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা বা গবেষণায় যাচ্ছে ১০-১২ শতাংশ। অথচ ৩৫-৪০ শতাংশ স্নাতক তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে বেকার বা আংশিক বেকার অবস্থায় থাকে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২৩)। জাতীয় যুব বেকারত্ব যেখানে ১০.৬ শতাংশ, সেখানে কৃষি স্নাতকদের বেকারত্ব প্রায় দ্বিগুণ। এ চিত্র দেশের কৃষিশিক্ষা ও শ্রমবাজারের মাঝে একটি গভীর অমিলের এবং নীতিগত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
দক্ষতা বনাম বাজার বাস্তবতা : বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি পাঠক্রম মূলত প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। যেখানে ফসল উৎপাদন, মাটির পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, সেচ প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব কৃষিকৌশল শেখানো হলেও উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রায় অনুপস্থিত। যেমন- কোম্পানি গঠন, বাজার বিশ্লেষণ, বিনিয়োগ সংগ্রহ এবং ক্যাশ ফ্লো ব্যবস্থাপনা, এই বিষয়গুলোর প্রশিক্ষণ কৃষি শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। ফলে কৃষি স্নাতকদের বড় অংশ কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইউজিসি কারিকুলাম রিভিউ রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাত্র ৫ শতাংশ কোর্সে উদ্যোক্তা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত। আইএফপিআরআই (২০২৩) এর গবেষণা অনুসারে, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষি স্নাতকদের মধ্যে ব্যবসা শুরুর সম্ভাবনা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই উদ্যোক্তা-শূন্য শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অধিকাংশ কৃষি স্নাতক চাকরির সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যেই আটকে থাকছে, যা কৃষির উন্নতির পথে বড় এক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
সুযোগের দোরগোড়ায় হারানো সম্ভাবনা : বাংলাদেশের কৃষিখাত প্রতি বছর গড়ে ৩.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও, সমগ্র এগ্রিবিজনেস খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ। উচ্চমূল্যের ফল-সবজি উৎপাদন, জৈব কৃষি, আধুনিক মৎস্যচাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষিপণ্য রপ্তানির বিশাল বাজার উদ্যোক্তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (Agri-SME) প্রসারের মাধ্যমে গ্রামীণ আয় বছরে ২-৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি সম্ভব। তবে উদ্যোক্তা দক্ষতার অভাবে অধিকাংশ কৃষি স্নাতক এখনো এসব উদীয়মান সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও বাজারমুখী দক্ষতা গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশের কৃষিশিক্ষা শুধু চাকরির জন্য নয়, উদ্যোক্তা তৈরির এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হতে পারে।
শিক্ষাক্রমে ‘অ্যাগ্রিপ্রেনারশিপ’ যুক্ত করার যুক্তি : বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায়, কৃষি পাঠক্রমে উদ্যোক্তা শিক্ষা যুক্ত করলে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ম্যানেজমেন্ট (গঅঘঅএঊ) ২০১৯-২০ সালে ১১টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যোক্তা মডিউল চালু করে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের স্টার্টআপ গঠনের সম্ভাবনা ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পায় (FAO I World Bank, ২০২৩)। ভিয়েতনামে ‘অ্যাগ্রিকালচার ইনোভেশন প্রোগ্রাম’ চালুর পরে তিন বছরে কৃষিভিত্তিক ব্যবসা নিবন্ধন ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এখন সময় এসেছে কৃষি শিক্ষায় ধাপে ধাপে উদ্যোক্তা মডিউল সংযোজনের। এর জন্য ব্যবসা সচেতনতাবিষয়ক কোর্স চালু, বাজারভিত্তিক প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, স্টার্টআপ ইনকিউবেশন সাপোর্ট গড়ে তোলা এবং চূড়ান্ত বর্ষে এগ্রি-স্টার্টআপ প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
পথ বদলানোর ডাক :  FAO-এর বাংলাদেশ প্রতিবেদন (২০২৩) অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষির ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যা এবং লবণাক্ততা কৃষির উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, যা আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, ILO-এর গ্রীন জবস অ্যাসেসমেন্ট ২০২৪ রিপোর্টে বলা হয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে কৃষি খাতে প্রায় ৩০ লাখ পরিবেশবান্ধব (Green Jobs) কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। তবে এই কর্মক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশ করতে হলে আমাদের প্রয়োজন উদ্ভাবনী, অভিযোজনযোগ্য এবং উদ্যোক্তা মনস্ক কৃষি পেশাজীবী। যুবক ও কৃষি স্নাতকদের জন্য নতুন ব্যবসায়িক সুযোগের সৃজন এবং কৃষির প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। ইউজিসি সতর্ক করে বলছে, যদি কৃষি শিক্ষায় উদ্যোক্তা দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত না করা হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরে কৃষি স্নাতকদের বেকারত্ব আরও ৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এটি কৃষি উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নতির পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
সাহসী পথচলার অনুপ্রেরণা : বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কিছু সাহসী উদ্যোগের সফলতা আমাদের অনুপ্রাণিত করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ‘Agroshift’ নামক একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকের পণ্য সরাসরি শহরের সুপারশপগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তারা ৫০টিরও বেশি সুপারশপে পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। ‘কৃষক বন্ধু’ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মও কৃষকদের জন্য বিশেষ কার্যকর, যেটি এক লাখেরও বেশি কৃষককে পরামর্শ দিয়ে গড় আয় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। ‘ইকোক্রপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান জলবায়ু সহনশীল বীজ উৎপাদন করে নেপাল ও মিয়ানমারে রপ্তানি শুরু করেছে। এছাড়া, কৃষির অগ্রগতির জন্য নানান উদ্যোগের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ, যা কৃষির সাস্টেইনেবিলিটি এবং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এইসব উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, যদি সঠিক সুযোগ তৈরি করা যায়, তবে তরুণ কৃষি স্নাতকরাই বাংলাদেশের কৃষি খাতকে পাল্টে দিতে সক্ষম। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা এবং উদ্যোক্তা মনোভাব কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে।
আগামী কৃষি-সাহসী স্বপ্নের ঠিকানা : বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষায় পরিবর্তন এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। শুধু গবেষক বা সম্প্রসারণ কর্মী তৈরি করাই নয় বরং উদ্যোক্তা ও নেতৃত্ব বিকাশকারী প্রজন্ম তৈরি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা কেন্দ্র স্থাপন করা, স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবসায়িক অনুদান প্রকল্প চালু করা প্রয়োজন। কৃষি শিক্ষায় উদ্যোক্তা মনোভাবের বিকাশ কৃষির আধুনিকায়ন এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের সফলতা নিশ্চিত করতে পারে। এটি শুধু চাকরি পাওয়ার বিষয় নয়। একজন কৃষি শিক্ষার্থীর স্নাতক জীবন শেষ হওয়া উচিত একটি সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক চিন্তা, সম্ভাব্য গ্রাহক নেটওয়ার্ক এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে। উদ্যোক্তা হওয়া এখন আর বিকল্প নয় বরং এটি বাংলাদেশের কৃষির নবযাত্রার মূল চাবিকাঠি। দেশের কৃষি খাতকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে।
যেখানে ফসলের সঙ্গে বেড়ে ওঠে স্বপ্ন : আগামী দিনের কৃষি বিপ্লব আসবে প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তার যুগলবন্দিতে। পৃথিবীজুড়ে কৃষি খাত আধুনিকায়নে বিপ্লব ঘটানোর জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্যোক্তা মনোভাবের প্রয়োজন। বাংলাদেশেও এই পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের কৃষি শিক্ষায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যদি আজকের কৃষি শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের দক্ষতা এবং উদ্ভাবনের চেতনায় গড়ে ওঠেন, তবে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং গ্রামীণ উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হবো। আমাদের কৃষি খাত শুধু ফসল উৎপাদন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না বরং কৃষি উদ্যোক্তা, প্রযুক্তি উদ্ভাবক এবং নেতৃত্ব বিকাশে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই পরিবর্তন শুধু দেশের কৃষির জন্য নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করবে। স্বপ্ন কেবল ফসলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং আমাদের চিন্তা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কৃষি-নেতৃত্বের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য নতুন ধরনের ভাবনা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি খাতে নতুন যুগের সূচনা করতে হলে স্বপ্নের সঠিক পথ ধরে, একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব গঠন করতে হবে যা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নকে সামনে নিয়ে যাবে। শুধু ফসল নয়, গড়ে তুলতে হবে স্বপ্ন, চিন্তা এবং ভবিষ্যতের কৃষি-নেতৃত্ব।
লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন

প্যানেল

×