
জন্ম মানেই একটা নতুন জীবনের শুরু। কিন্তু সেই শুরুর সঙ্গেই জীবনে শুরু হয় যুদ্ধ। ছোটবেলায় হঠাৎ করে বলা হয়, ‘ভালো রেজাল্ট করতে হবে’, ‘প্রথম হতে হবে’, ‘স্কুলের সেরা হতে হবে’। কিন্তু কেউ কখনো বোঝায় না কেন, কিসের জন্য। ধাপে ধাপে ক্লাস টেস্ট, সেমিস্টার, বোর্ড পরীক্ষা পেরিয়ে যখন একজন শিক্ষার্থী এইচএসসি শেষ করে, তখন সে পৌঁছে এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়ংকর চাপে ভর্তি যুদ্ধ।
এই যুদ্ধ কেবল সিট পাওয়ার জন্য নয় এটি আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার লড়াই। এই যুদ্ধ একজন তরুণের স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, মানসিক স্থিতি ও ভবিষ্যতের রূপরেখাকে একসঙ্গে টেনে ধরে। আর এই যুদ্ধে জিততে না পারলে সমাজ, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এমনভাবে বাঁকা চোখে তাকায়, যেন সে জীবনের সকল যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
আজকাল অনেকে বলেন, জন্মের অবস্থান আমাদের হাতে নেই, কিন্তু জীবনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা আমাদের হাতেই। কেউ যদি অভাব, প্রতিকূলতা কিংবা সীমাবদ্ধতার ভেতর জন্মেও নিজের চেষ্টা, মেধা, ও শ্রম দিয়ে জীবনের মানচিত্র বদলে ফেলতে পারে তবেই সে প্রকৃত বিজয়ী। কিন্তু বাস্তবতা এতটা সহজ নয়। প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী প্রয়াস নিচ্ছে, নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে, অথচ প্রতিযোগিতা, সুযোগের অসম বণ্টন আর দুর্বল কাঠামোর কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছে।
আমাদের দেশের ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা এমন এক নির্মম দৌড়, যেখানে সবাইকেই এক লাইনে দাঁড় করানো হয়। অথচ সবার প্রস্তুতির সুযোগ এক নয়। কেউ শহরের নামকরা কোচিং সেন্টার থেকে প্রফেশনাল গাইডেন্স পায়, কেউ গ্রামের সীমিত উপকরণে শুধু বইয়ের পাতা আঁকড়ে ধরে। শহরের একজন ছাত্র যেখানে মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন মডেল টেস্ট, সেরা শিক্ষকের ভিডিও লেকচার পাচ্ছে, সেখানে গ্রামে অনেকেই টিউশনের টাকাও জোগাড় করতে পারছে না।
এই অসম বাস্তবতার মাঝেও একজন শিক্ষার্থী যখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকে, তখন তার চারপাশে জন্ম নেয় অজস্র চাপ- পারিবারিক প্রত্যাশা, আত্মীয়ের তুলনা, বন্ধুর ফল, সমাজের কথা, আর নিজের অজানা ভবিষ্যতের ভয়। প্রতিটি ভুল উত্তর তাকে কেবল নম্বরের দিক থেকেই নয়, মানসিকভাবেও পিছিয়ে দেয়।
চান্স না পেলে যেন তার পরিচয়টাই পরিবর্তন হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন প্রশ্ন করে, “কোথাও ভর্তি হতে পারলি না?”, প্রতিবেশী বলে, “ফেল করছিস?”, সমাজ তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন তার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। অথচ কেউ ভাবে না, এই শিক্ষার্থীটি কতটা শ্রম দিয়েছে, কত রাত সে ঘুমায়নি, কত স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে প্রতিদিন।
আমরা ব্যর্থতাকে খুব সহজে দোষ হিসেবে দেখি। কিন্তু ব্যর্থতা হলো শেখার সবচেয়ে বাস্তব ও শক্তিশালী ধাপ। যারা আজ চান্স পায়নি, তাদের বেশির ভাগই কাল অন্যভাবে সফল হতে পারে- ব্যবসা, অন্য কোনো স্কিলে, কিংবা ভবিষ্যতের অন্য কোনো পরীক্ষায়। শুধু দরকার একটু সময়, আত্মবিশ্বাস এবং সহানুভূতি।
এই সমাজে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা কেবল তার এক দিনের পরীক্ষার ফলের দিকে তাকাই, তার যাত্রা, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা বা আত্মত্যাগের দিকটা দেখি না। অথচ সত্যিকারের মেধা শুধু নম্বর বা চান্সে সীমাবদ্ধ নয়। মেধা হলো সমস্যার সমাধানে, প্রতিকূলতায় স্থির থাকার শক্তিতে এবং বারবার ব্যর্থ হয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর সাহসে।
এই অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব আছে ব্যর্থতার পর একজন শিক্ষার্থীকে বলার, “তুমি পারো, আবার চেষ্টা করো।” একটা ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া মানেই জীবনের শেষ নয়। বরং এটি হতে পারে নতুন কোনো সম্ভাবনার শুরু।
শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। তুমি যতক্ষণ চেষ্টা করে যাচ্ছো, ততক্ষণ তুমি হেরে যাওনি। নিজের ভালো লাগা, আগ্রহ, দক্ষতা ও বিকল্প পথ চিন্তা করতে শিখো। জীবন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে আটকে নেই। কেউ হয়তো আজ চূড়ান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেছে, কিন্তু তুমি হয়তো আগামী দিনে নিজের পথ নিজেই বানিয়ে নেবে এবং হয়তো একদিন তার চেয়ে অনেক বড় কিছু করে দেখাবে।
তাই যারা এখনো ভর্তি যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছো, যারা বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হচ্ছো, তাদের উদ্দেশ্যে বলি- থেমো না, লড়াই চালিয়ে যাও। এই যুদ্ধ কেবল সিটের জন্য নয়, এই যুদ্ধ তোমার স্বপ্ন, আত্মপরিচয় আর সম্ভাবনার জন্য। তোমার পথ হয়তো অন্য সবার মতো হবে না, কিন্তু সেটা একেবারে মূল্যহীন এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সামনে এগিয়ে যাও। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্জনগুলো অনেক সময় শুরু হয় ছোট্ট একটা ব্যর্থতা থেকে।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ
প্যানেল